মো.নজরুল ইসলাম,মানিকগঞ্জ:
১.
ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের আর্বিভাব প্রচার ও প্রসারে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত অলি আউলিয়াদের অবদান অনস্বীকার্য্য। এই অঞ্চলে তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ ও অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং সমাধিকে ঘিরে গড়ে ওঠেছে কল্পলোক বিশ্বাসের এক ভিন্ন সংস্কৃতি। আমরা আজ মাজারের ইতিহাস টিকে থাকার প্রয়োজনীয়তা এবং অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ বির্নিমানে মাজারের
অবদান নিয়ে আলোকপাত করব।
ইতিহাসে মাজার একটি আরবি শব্দ। এটি ফারসি দরগাহ শব্দের প্রতিশব্দ। এর ধাতুগত অর্থ ‘জিয়ারতের স্থান’ বা দর্শনের স্থান্। এক্ষেত্রে সব মুমিনের কবরই ‘মাজার’, কেননা সব মুমিনের কবরই জিয়ারতের স্থান এবং কবরই জিয়ারত করা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে মাজার বলতে সাধারণত অলি-আওলিয়া, দরবেশগণের সমাধিস্থলকে বোঝায়। আরবিভাষী বিশ্বে মাজারকে মাকাম বলা হয়। মাজারকে রওজা বা কবরও বলা হয়। ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সা:) মদীনার কবরস্থান জান্নাতুল বাকিতে এবং উহুদের যুদ্ধে শাহাদতপ্রাপ্ত সাহাবিদের কবরস্থানে গমন করতেন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। সুফিতত্তে্বর অনুসারীরা সুফী দরবেশদের কবরস্থান জিয়ারত করতে পছন্দ করেন। অনেক মাজারে সমাধিস্থ ব্যক্তির ওরশ অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। একে ঈসালে ছওয়াবের মাহফিল বলে। ঐতিহাসিক মাজারগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়াকফ সম্পত্তি থাকে এবং খাদিমও থাকেন; অনেক ক্ষেত্রে তারা উত্তরাধিকারসূত্রে এ পদে অধিষ্ঠিত হন।
মাজারওয়ালারা মূলত পাক পাঞ্জাতনের অনুসারী,ভক্ত এবং বংশধর। আর মাজার ভাংচুরকারীরা পাক পাঞ্জাতনের ঘোর বিরোধী এবং ইয়াজিদের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী।
এই দুই গ্রুপের মধ্যে দ্বন্ধসঢ়;দ্বটা মূলত ১৪০০ বছর ধরে সেই কারবালার ময়দান থেকে। যা যুগ যুগ ধরে দ্বন্ধসঢ়;দ্বটা আবহমানকাল ধরে সারাবিশ্বে বিরাজমান। এই দ্বনদ্বটা গড়ে ওঠেছে বংশপরম্পরায় এবং মাযহাব ও আকিদাগত অমিল থাকার কারণে। যেমন-মাজার ভক্ত মানুষেরা দয়াল রাসূল পাক (সা:) কে নুরের তৈরি এবং সর্বপ্রথম সৃষ্টি মনে করে থাকে। পক্ষান্তরে মাজার বিরোধী মানুষরা রাসূলে খোদাকে মাটির তৈরি এবং সর্বপ্রথম কলম তৈরির কথা বলে থাকে। মাজার ভক্ত মানুষেরা দয়াল রাসূল পাক (সা:) কে সর্বজায়গায় হাজির-নাজির এবং গায়েব জানলেওয়ালা বিশ্বাস করে থাকে। অপরদিকে মাজার বিরোধী মানুষরা এগুলো বিশ্বাস করে না এবং এমন মতবাদকে কুফরি হিসাবে গণ্য করে। মাজার ভক্ত মানুষেরা ভক্তিসহকারে দয়াল রাসূল
পাক (সা:) এর উপর প্রতিনিয়ত কিয়ামসহ মিলাদ শরিফ পড়ে থাকে। এবং রাসূলে খোদার শুভ জন্মদিন উপলক্ষে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ ঈদ পালন করে থাকে। অপরদিকে মাজার বিরোধী মানুষরা এমন কাজকে গর্হিত এবং বিদআত বলে
থাকে। তাছাড়া মাজার ভক্ত মানুষেরা সবসময় শান্তিপ্রিয় ও অসাম্প্রদায়িক হয়ে থাকে। এরা সবসময় পীরের শিক্ষামতে ধ্যান সাধনায় মগ্ন হয়ে নিজকে নিজ চেনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। এরা ষড়রিপু অর্থাৎ সকল পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য যুগের পর যুগ সাধনা করে থাকে এবং এটাকে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত মনে করে থাকে। তাছাড়া এরা সর্বক্ষণ আল্লাহর স্মরণে নিমজ্জিত থাকতে চেষ্টা করে এবং এটাকে দায়েমী সালাত বিশ্বাস করে থাকে। মাজার ভক্ত মানুষগুলো আল্লাহ, রাসূল এবং পীরের শানমান নিয়ে রচিত সামা,কাওয়ালী এবং ভাবসংগীতকে মনের খোরাক হিসাবে গণ্য করে থাকে। এরা অন্য্যন্য মানুষের মতো সমাজে
বসবাস করলেও এরা সমাজনীতি, রাজনীতি এবং অর্থনীতি থেকে বিমুখ। এরা বেহেশত এবং সোয়াবের আশা করে না বরং সবসময় আল্লাহ এবং রাসূলে খোদাকে রাজিখুশি এবং তাঁদেরকে কাছে পাওয়ার জন্য পাগল থাকে। অপরদিকে মাজার বিরোধী মানুষগুলো যেকোনো মূল্যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে চায়। হোক সেটা অরাজকতা অথবা যেকোনো উপায়। মাজার ভক্ত মানুষগুলো জীবন গেলেও দয়াল রাসূল পাক (সা:) কে নুরের তৈরি, হাজির-নাজির এবং গায়েব জানলেওয়ালা বিশ্বাস করে থাকে। কিন্তু মাজার বিরোধী মানুষগুলো এগুলো মানতে নারাজ এবং বিদআত, কুফর এবং মারাত্মক গুনাহ মনে করে থাকে। তাই উভয় পক্ষের মানুষ একই সমাজে বসবাস করলেও দুই মেরুর বাসিন্দা। উভয় পক্ষের লোক কোরআন ও হাদিস দিয়ে তাদের স্বপক্ষে দলিল পেশ করে থাকে। মাজার ভক্ত মানুষেরা তাদের নিজ নিজ পীরের মাধ্যমে এসব আকিদা পোষণ করে থাকে। অপরদিকে মাজার বিরোধী মানুষরা তাদের ধর্মগুর আবদুল ওহাব নজদী, ইবনে তাইমিয়া এবং আবুল আলা মওদুদির ভাবাদর্শে বিপরীতমুখী আকিদায় বিশ্বাসী। দয়াল রাসূল পাক (সা:) কে কেন্দ্র করে আকিদাগত অমিল থাকার কারণে উভয় পক্ষ একে অপরকে শক্ত মনে করে থাকে। তবে সুফিবাদী লোকজন উগ্রতা পছন্দ করে না। তাদের মতবাদ মানুষকে ভালোবেসে কাছে টেনে শিক্ষা দিতে চায়। অপরদিকে মাজার বিরোধী মানুষগুলো তাদের মতবাদ জোর করে কলা কৌশলের মাধ্যমে চাপিয়ে দিতে চায় এবং সুফিবাদী মতবাদ দমন করতে বিভিন্ন অজুহাতে হামলা করে থাকে। তাই তাদের রাগ ও হিংসা মাজার ওয়ালা ব্যক্তির উপর। এটাই অন্যতম অন্তর্নহিত কারণ। সুফিবাদী লোকজন মনে করে আগে নিজকে শুদ্ধ করতে হবে এবং চরিত্রই ধর্মের মূল। আগে নিজে শুদ্ধ, তারপর পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র শুদ্ধ হবে। অপরদিকে মাজার বিরোধী লোকজন ইসলামি খেলাফত চালু করে জোর করে আইন করে সমাজে শান্তি আনতে চায়। কিন্তু সুফিবাদী লোকজন জোর জবরদস্তিতে বিশ্বাসী নয় বরং প্রেমের ধর্মে আত্মবিশ্বাসী এবং মানবসেবাকে পরম ধর্ম মনে করে থাকে। এদের বিশ্বাস মানুষের ভিতরে স্রষ্টার বসবাস, তাই মানবসেবার মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টির উত্তম উপায়। হোক সে হিন্দু, বৌদ্ধ,খ্রীষ্টান অথবা মুসলিম। তারা মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করে না বরং তাদের কাছে মানুষ হিসাবে সবাই সমান। এসব কারণেই উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বটা প্রকট আকার ধারণ করছে।
২.
বাংলাদেশের মাজারগুলোর অতীতের চিত্র এখন পুরোটাই বদলে গেছে। এদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় শরিয়তী ইসলামপন্থী রাজনৈতিককর্মী ও নেতাদের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সঙ্গে মারফতী মাজার সংস্কৃতি পড়েছে বিপন্নতার মুখে। এই সকল মাজারে গত কয়েক বছরের বোমা হামলার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিবছর নিয়ম করে বাৎসরিক ঔরস যেমন ঘটা করে পালিত হত তেমনি সপ্তাহান্তে প্রতি বৃহস্পতিবারের গান-বাজনা-জটলা সবই হত। মাজারের আশেকানদের আনন্দের সেই সব আয়োজনের ইতি ঘটেছে সিলেটের শাহ জালাল মাজারের বোমা হামলার পর থেকে। গত কয়েক বছরে সারাদেশের কিছু মাজারে ঘুরে দেখেছি এখন সব
মাজারই তার পূর্বের আসল চরিত্র হারিয়েছে।
মাজারকেন্দ্রিক কয়েকটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি: বহু দিন আগেই বিশেষ করে ছাত্র জীবনে গ্রামে গ্রামে ঘুরছি, গান-বাদ্য শুনছি, অভিনয় দেখছি, আর এক মায়া-ছায়ার জীবন অতিক্রম করছি। এরমধ্যে একসময় আমার মন বলল, সরেজমিনে
মানিকগঞ্জ ও ঢাকা শহরের গান-বাদ্যের খোঁজখবর নিয়ে দেখা দরকার। আমি হাই স্কুলে পড়ার সময় কোন এক কারনে বাড়ি থেকে রাগ করে পালিয়ে জীবনের প্রথম অপরিচিত জায়গা ঢাকা মিরপুর শাহ আলীর মাজারে এসেছিলাম। কাছে ৩৬০ টাকা আছে কোনভাবেই খরচ করা যাবেনা। মাজারের খাবার খেয়েই কয়েকদিন থাকতে চাই। পেটে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে কিন্তু খাবারের নিশানা পাচ্ছি না।
ঘুরতে ঘুরতে মাজারের পেছনে খাবার ঘরে সন্ধান পেলাম কিন্তু তারা এখন খাবার দিতে নারারজ। মন খারাপ করে মাজারের ভেতরে বসে রইলাম। প্রচুর বাতাসা ও মিস্টি জাতীয় খাবার খেয়ে ভালো লাগছে না। ইতিমধ্যে একটি ভ্যানে খিচুরির প্যাকেট যাচ্ছে, আমি তরিঘরি করে চলে এলাম এখানেও পাগলদের প্রচুর সিরিয়াল। ঠেলাঠেলি করে কোনমতে এক প্যাকেট নিতে পারলাম। কোনমতে পেটে জামিন দিয়ে থাকলাম। রাতেও একই যুদ্ধ করে খেয়ে গান বাজনায় মত্ত এবং নিজস্ব গাট্টি মাথায় দিয়েই ফ্লেরেই ঘুমাতে হলো। খাদেম ও পাগল দের আলাদা বেডরুম দেখলাম। সবচেয়ে বড় সমস্য হলো লম্বা সিরিয়ালে টয়লেট যুদ্ধ করে গোসলের সিরিয়াল পাচ্ছি না। কি করা মজারের পেছনে দুর্গন্ধযুক্ত মজা পুকুরেই নেমে দেখি অসংখ্য পাগল সাতার কাটছে। কোনমতে কাজ সেরে বাবার দরবারে শেষ মোনাজাত করে বিদায় নিলাম। মানিকগঞ্জের ঝিটকা আল্লা বাজান, লোকমান সাহ, সিংগাইরে শাহ রুস্তম, সাটুরিযা কালুশাহ ুফকির, মহাদেবপুর বাহের পাগলার মাজারসহ প্রায় সকল দরবারেই আসা-যাওয়া ও থাকার সৌভাগ্য হয়েছে।
আমার প্রতিবেশী কাকা জুলেখান বাহের পাগলার ভক্ত ও চাচাতো ভাই আজমীর পাগলার ভাইরা ভাই হওয়াতে সপ্তাহের বৃহস্পতিবার জলসায় সবচেয়ে বেশি থাকা ও খাওয়া হয়েছে বাহের পাগলার আস্তানায়। এরকম অসংখ্য ঘটনা ও স্মৃতি রয়েছে তবে আসল কথায় আসি।
মাজার ও দরবারের কিছু গানের স্মৃতি এভাবেই বলতে পারি- যদি এসে থাকো দয়াল তরাতে কাঙ্গাল,(দয়াল) আমারে নিয়ো পার করিয়া। (আমি) নামাজ তো পড়ি না রোজা তো রাখি না,পার করে দাও দয়া করিয়া, আমি ভবেতে আসিয়া মায়াজালে পড়িয়া,গিয়াছি তোমাকে ভুলিয়া। ও দয়াল আমারে নিয়ো পার করিয়া। আল্লা নবীর নাম লইয়া আসরেতে দাঁড়াইলাম। বিসমিল্লা বলিয়া মুখের জবান খুলিলাম। প্রথমে বন্দনা গো টানি, মক্কাতে লইলেন জন্ম মুহাম্মদ নবী। হযরত আলী মা ফাতেমা,ইমাম হুসেন যাহার নাম। বিসমিল্লা বলিয়া মুখের জবান খুলিলাম। খাজাবাবা খাজাবাবা মারহাবা মারহাবা,গেয়েছিলো নবীর গুণগান। আমার শাহ আলী বাবার
লীলাখেলা দেখবি যদি আয়,আমার মাইজভান্ডরীর লীলাখেলা দখবি যদি আয়। আয়, দমে দমে মাইজভারীর লীলা দেখা যায়। আয়, দমে দমে আলী বাবার লীলা দেখা যায় ইত্যাদি।
কেবল গান নয়, তারা যেন সুরের জিকিরই করছেন। এ জিকিরে নারী-নরে কোনো ভেদ নেই। সকলে এইখানে সুরে সুরে প্রেমভক্তিতে একাকার। তাই তো আকুল হয়ে সকলে মিলে বাদ্যবাদনে, দোহারকিতে প্রেম-ভক্তি যোগে গাইতে থাকে আদ্ধাত্ত্বিক
এই গানগুলো। ঢোল, হারমোনিয়াম, মন্দিরা, কাঠজুড়ির দমকে দমকে আকুল হয়ে নিবেদনমূলক এই গানে তারা অন্তরে জিকির জাগিয়ে তুলে ছিল। আর সেই জিকিরের ভালবাসাময় প্রেমের দাবিতে তারাই আবার গেয়ে উঠেছিল তোমার রওজায় এসেছি,খালি হাতে যাবো না। আশা পূরণ করে দাও,শাহ আলী নিরাশ করো না। আমি গুনাগান ভরসা তুমার, চরণছাড়া করো না। আশা পূরণ করে দাও, খালি হাতে যাবো না।
এগুলো শুনে আমি রীতিমতো থমকে গিয়েছিলাম। এ আবার কেমন দাবি খালি হাতে যাবো না। মনে মনে উত্তর পেয়েছিলাম প্রেমভক্তির দাবি এমন হতে বাধ্য। প্রেমবাক্যে কিছু চাওয়া মানে অবশ্যই পাওয়ার দৃঢ়তা অন্তরে পুষে রাখা। সারা দেশের মাজারের গানগুলোতে সেই প্রেমবাক্যই ঘুরে ফিরে আসতে শুনেছিলাম।
বাংলাদেশের মাজারগুলোর অতীতের চিত্র এখন পুরোটাই বদলে গেছে। এদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় শরিয়তী ইসলামপন্থী রাজনৈতিককর্মী ও নেতাদের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সঙ্গে মারফতী মাজার সংস্কৃতি পড়েছে বিপন্নতার মুখে। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাজারে ঘটেছে বোমাবাজির মতো ঘটনা। আর এই উছিলায় আশেকানদেরকে মাজারের বাইরে বের করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মাজারে প্রকৃত চিত্র আশেকানদের সমাবেশ ও গান। তৎপরিবর্তে মাজারে এখন শরিয়তী ইসলামী নেতারা ঢুকে পড়েছেন। তারা এখন মাজার-সংস্কৃতির চর্চাকে বাদ দিয়ে মাজারকে শরিয়তী অনুসাশনের মধ্যে নিয়ে এনেছেন এবং একদল ওহাবী মৌলানারা মাসলা দিয়ে ধর্ম ব্যাবসা জায়েজ করেছে এবং পাগলদের পেটে লাথি দিয়ে নিজেদের আখের নিয়ে ব্যস্ত আছেন। এখানকার হালুয়া রুটি ও ভাগ বাটোয়ারা নিয়েও নানা দ্বন্দ্ব সংঘাত হচ্ছে। এখন আর বাংলাদেশের প্রধান কোনো মাজারে গান ও আশেকানদের ভাব সমাবেশ দেখা যায় না।
বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার সিলেট শাহ জালাল, শাহ পরানের মাজারে গিয়েছি। একবার সেই মাজার এলাকায় শুনশান নিরবতা দেখে বিস্মিত হয়ে উঠেছিলাম। ব্যাপার কী! উত্তর পেলাম মাজার এলাকার বাইরে বসা কয়েকজন আশেকানের মুখে। তারা জানালেন, মাজারে এখন আর কোনো গান-বাজনা হয় না। তবে, ভক্তরা তাদের মানত নিয়ে মাজারে আগের মতো এখনও আসে। কিন্তু সেগুলো
এখন ভোগ করে মাজারের দখলদারী ওহাবী জামাতী নেতারা। সিলেট শহরের মাজারে ঘুরে ঘুরে দুদিনেও কোনো গান শুনতে পারিনি। শেষকালে ফিরে আসার পথে শাহ পরানের মাজার প্রাঙ্গণের পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দোতরার সুর ভেসে আসতে শুনি। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে সুরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। বহু দূর এগিয়ে গিয়ে দেখি ফাঁকা মাঠের মধ্যে একটি গাছতলায় বসে দোতরা বাজিয়ে তরুণ এক ভক্ত গান গাইছে লা ইলা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদ রাসুলৃ। গান শেষে তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে জানতে পারি, মাজারের ত্রিসীমায় এখন আর গানের প্রবেশ নেই। তবে, মিলাদ-নামাজ এই সব হতে পারে। আশেকান হয়ে আমাকে তাই দূরে বসে গান গাইতে হয় বাবা শাহ পরানের শানে।‘
একই ধরনের কথা জানালেন ঢাকার মিরপুরের শাহ আলীর মাজারের খাদেম্ মাজার এখন আশেকানদের জন্য নয়। আগে যেখানে সারা রাত আশেকান-ভক্তে মাজার আলোকিত থাকত। এখন কি কোনো ভক্ত-আশেকান দেখছেন? আমি তার কথার ভিতর শাহ আলীর
মাজার প্রাঙ্গণে তাকিয়ে দেখি, কোনো ভক্ত প্রাণীর হদিস শাহ আলীর মাজারে বৃহস্পতিবারেও নেই! অথচ এর আগে বহুবার আমি এই দিনে এই মাজারে গিয়ে দেখেছি আশেকান-ভক্তদের বিশাল সমাবেশ, গান-বাদ্য আর ভক্তির নিবেদনমুলক জিকির নৃত্য। আর আজ সেই শাহ আলীর মাজার জনশূন্য। খাদেমের মাধ্যমে জানা গেলো,মাজার এখন জামাতের নেতাদের দখলে, তবে ক্ষমতা ভেদে সভাপতি বিএনপি/আমলীগের হয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের ভার মৌলবাদী নেতাদের হাতে। তারা মাজারে গান বন্ধ করে দিয়েছে।
আসলে, গত কয়েক দশকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও মাদ্রাসা কেন্দ্রীক ওয়াজের বিকাশে বর্তমানে বাংলাদেশের মাজার সংস্কৃতির চেহারা একেবারে বদলে গেছে।
মাজার সংস্কৃতি রূপ নিয়েছে মসজিদ সংস্কৃতির কাছাকাছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে মাজার সংস্কৃতি নিয়ে নতুনভাবে ভাবনার অবকাশ আছে বৈকি। বর্তমানে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে মৌলবাদের আসল চেহারা ফুটে উঠেছে। তারা এখন মাজার,ভাস্কর্য ভাঙার মহাউৎসবে মেতে উঠেছে।
৩.
ইসলাম প্রচারের যুগে অলি-আউলিয়ারা আরব দেশ থেকে উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েন এবং এসব দেশে স্থায়ীভাবে রয়ে যান। এখানেই তাদের মৃত্যু হয় এবং ক্রমশঃ তাদের কবরগুলো পরিণত হয় মাজারে।মাজারের ভক্তরা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সংমিশ্রণ এবং
তাদের আগমনও হয় বিভিন্ন স্থান থেকে।কিছু সাধারণ আচার-অনুষ্ঠান যেমন আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালানো,গোলাপ পানি ছড়িয়ে দেওয়া,সিন্নি বা মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য দান করা ইত্যাদি সব মাজারেই পালন করা হয়ে থাকে। ইসলামের বৃহৎ ঐতিহ্য থেকে মাজার সংস্কৃতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে,যদিও এর উদ্ভব ধর্মীয় সংস্কৃতির মূল হতে। মাজার সংস্কৃতিকে মনে করা হয় প্রান্তিক।
মাজার কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমানদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালন করে থাকে। যেমন মিলাদুন্নবী,মহররম,ফাতেহা-ই-ইয়াজদহম,শবে কদর,শবে বরাত ইত্যাদি। মাজার সংস্কৃতিতে ওরস একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
ভারতের আজমীর শরীফে খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর মাজারে ওরস প্রধান উৎসব হিসেবে পালিত। ওরস অনুষ্ঠানে থাকে কবরকে বিভিন্ন মসলা দিয়ে গোসল করানো,নতুন গিলাফ পরানো,চাদর জড়ানো,দোয়া-দরূদ পাঠ করা ইত্যাদি। বাংলাদেশের শাহ আলী
বাগদাদীর ওরসে দ্যাখা যেত যে ফকির-পাগলরা ওরস উৎসব পালন করে নাচ-গান-বাজনা সহকারে। তিনদিন তিনরাত এসব ফকির-মাস্তানরা প্যান্ডেল টানিয়ে মাইক সহযোগে নাচ-গান করে,মদ-গাজা খেয়ে ফুর্তি করত এবং শেষদিন সকলের দান করা সিন্নি এবং চাল দিয়ে রান্না করে সবাই খেত। উন্মাদের মতো জিকির করা,আউলিয়াদের কাছে কিছু কামনা করে মানত করা এসবই ইসলামের নিয়মনিষ্ঠ আচরণের বিপরীত বলছে একদল মোল্লারা।
৪.
যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে মাজারের অন্য একটা দিক আছে। মাজার সংস্কৃতির শক্ত ভিত হলো অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী চেতান। কোন কারনে বা কেন একজন খাঁটি হিন্দু মুসলিম একজনের মাজারে মানত করে? যে মানত করে সে কি সব জায়গায় মানত করে? মানত করা অভ্যাস তাই করে? আমার মনে হয় না। সিলেটে দেখছি, ভারতের আজমেরি শরীফের কথা শুনেছি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ এই সব মাজারে গিয়ে বসে থাকছে, মাথা ঠুকছে। এই যে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র মাজারের, এটাই শক্তিশালী করে রেখেছে মাজারকে। মাজার কাঁটাতারের বেড়া কেও অতিক্রম করে। শেরপুরের সীমানা মানে বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষে যে মাজার আছে সেখানে যখন ওরস হয় বর্ডার খুলে দেওয়া হত এই সেদিনও। কোন এক অজানা কারনে এখন বন্ধ আছে। চরনতলায় যে মেলা হয় তা যদিও ওরস না, কালীপূজা উপলক্ষে মেলা তবুও সেই মেলায় বর্ডার ওপেন থাকত সব সময়। আমার দেখার সৌভাগ্য না হলেও আমার বন্ধুদের অনেকেরই এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু কোন অজানা কারনে এখন আর বর্ডার ওপেন থাকে না। যদিও কামালপুরের মাজারের ওরসের সময় কাঁটাতারের দুই পাসে মানুষ জময়ায়েত হয়, দুই পাসেই মেলা বসে, কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দান খয়রাত সব চলে, শুধু বর্ডার ওপেন থাকে না। বিএসএফ আর বিজিবি দাঁড়িয়ে থাকে পাহারায়। মাজারগুলো ঘুরে
দেখলাম মানুষের ঢল আর সার্বজনীন চরিত্র। মাজরে পাগলদের নিয়ে গান ও গাজার আড্ডা নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে ওহাবী মোল্লাদের। যাহোক আমাদের মানিকগঞ্জে বাঠইমুরী হযরত আফাজ উদ্দিন (র.) আজিমপুরে ফকির মওলা দরবার শরিফসহ অসংখ্য মাজারে পাগলদের আড্ডার মধ্যে অনেক কিছু শেখার আছে। এক প্রান্তে পাগলদের জন্য আলাদা করে জায়গা করে দেওয়া আছে। সেখানে তাঁবু টাঙ্গিয়ে তাঁরা থাকে। ওরস বা মেলার প্রাণ এরা। এরাই সারা দেশে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ওরসে যোগ দেয়। আমরা গাঁজা বললেও তারা এটাকে সিদ্ধি বলে এবং গভীর ভক্তি বিশ^াস নিয়ে আশ^াধন করে থাকেন। এখানে কোন লুকোচুরি নেই সবাই সমান। বানাচ্ছে, খাচ্ছে, মেলে নিয়ে বসে আছে এবং শৃঙ্কলার সহিত ভক্তদের মাঝে বন্টিত হচ্ছে। পাগলদের আড্ডাও অনেক বড়। সারা দেশ থেকে সবাই হাজির হয়।
এক ওরসে দেখলাম গান চলছে, ঢোল করতালের শব্দে পরিবেশ যেন হয়ে উঠছে অন্য রকম। ওরস নাকি এখনো জমেনি, কিন্তু আমি পা ফেলার জায়গা পাচ্ছি না। জমে গেলে সেখানে নাকি দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। এক দোকানীর সাথে কথা বললাম
মাজার সম্পর্কে, তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন, কয়েক হাজার বছর পুরাতন মাজার এটা। বুঝলাম মিথ এভাবেই তৈরি হয়। সকল মাজারেই শাঁখা সিঁদুর পড়া নারী, ধুতি পড়া বৃদ্ধ, টুপি পড়া মাওলানা সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে কবরের কাছে যাচ্ছে, খাদেম কে যার যার সাধ্যমত দান খয়রাত করে আসছে। পাসে সরে যাচ্ছে অন্য জন এসে দাঁড়াচ্ছে। রান্না করে আনছে, কেউ এখানেই রান্না করে খাওয়াচ্ছে সবাই কে।
মাজার ও খানকাতে ওরস চলবে এবং এটা নিশ্চিত যে আশেপাশের কোন পরিবার না খেয়ে থাকবেন না। ঐতিহাসিক মূল্য ছাড়াও, মাজারের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আর এর অছিলায় গরিব দুঃখীসহ ছিন্নমূল অসংখ্য এতিম পাগলদের তিন বেলা খাওর ব্যবস্থার জন্যও না হয় টিকে থাকুক মাজার গুলো। মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোও টিকে থাকুক এই কারণে যে এগুলো ধর্মবিশ^াসীদের একটি সামাজিক প্রতিকি কেবল নয়। এখানে অসংখ্য এতিম ছেলেমেয়েরা অন্তত আলু ভর্তা পাতলা ডাল ভাত খেয়ে জীবন বাঁচতে পারছে। মসজিদে শিরনীর আশায় শিশুরা আদব কায়দা শিখছে। ভিন্ন ধর্মালয় গুলোতেও মানুষের আহার বিহার ও মেলাকেন্দ্রীক ফটকা কারবারে অর্থনীতি সচল থাকছে। এভাবে সমাজে সকল ধর্মে মানুষ যেন মঙ্গলজনক সহঅবস্থানে থাকতে পারে। জগতের প্রায় ৪২০০০ ধর্মের নৈতিক চর্চাগুলো বেঁচে থাকুক কেবল মানুষের কল্যানের জন্য। কে সত্য কে মিথ্য,কে আস্তিক কে নাস্তিক এবং নিজেদের মতবাদের শ্রেষ্ঠত্য পরিহার করে যত মত তত প্যথকে শ্রদ্ধা করি। সকল প্রাণবৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বহুত্ববাদী সামাজিক ন্যায্যতার সমাজ বিনির্মানে ঐক্যবদ্ধ হই।
[ মো.নজরুল ইসলাম: সাধারন সম্পাদক,বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ,মানিকগঞ্জ]