বাংলাদেশে অপ্রাপ্তবয়স্ক এক কিশোরীকে ২৭ বছর বয়স দেখিয়ে গত বছর সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল গৃহকর্মী হিসেবে।
গত শনিবার নদী আক্তার নামের মেয়েটির লাশবাহী কফিন ঢাকায় পৌঁছায়। মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে বলে দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এর আগেও ১৪ বছর কিশোরীর বয়স বাড়িয়ে বিদেশে কাজ করতে পাঠানো হয়। দেড় বছর যেতে না যেতেই তাকেও ফিরতে হয় লাশ হয়ে।
সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে পাঠাতে হলে বয়স ন্যূনতম ২৫ বছর হতে হয়। এই বয়স যাচাই করা হয় প্রার্থীর জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয় পত্র বিশেষ করে পাসপোর্ট তৈরির সময় পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে।
তারপরও এতো অল্পবয়সী মেয়েরা কিভাবে দেশের বাইরে শ্রমিক হিসেবে যেতে পারছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে এই নারীদের বয়স বাড়িয়ে বিদেশ পাঠানো নতুন কোন ঘটনা নয়।
বাংলাদেশে জন্ম নিবন্ধন এখনও সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে না হওয়ায় বয়সে হেরফের করার সুযোগ থাকছে যা কারণে পাসপোর্টেও ভুল তথ্য যুক্ত হয়ে যাচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আইয়ুব চৌধুরী।
সাধারণত পাসপোর্টের ফর্মে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে তার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলে জন্ম নিবন্ধন সনদের নম্বর দিতে হয়। ফর্মে লেখা নম্বরের সাথে পরিচয়পত্র বা সনদের মিল থাকলেই পাসপোর্ট ইস্যু করা যায়।
এরপর প্রার্থীর বয়স, ঠিকানাসহ অন্যান্য তথ্য যাচাই করা হয় পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিলেই সেই পাসপোর্ট প্রিন্ট করা যায়।
বাংলাদেশে জন্ম নিবন্ধন পদ্ধতিটি এখনও পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করা যায়নি। সাধারণত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এসব সনদের অনুমোদন দিয়ে থাকে। সেখানেই তথ্য পাল্টে দেয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
মি. সরকার বলেন, “যদি স্থানীয় সরকার কাউকে ভুল তথ্যের জন্ম সনদ দিয়ে দেয়। কেউ যদি একাধিকবার নিজের ইচ্ছামত বয়স বদলে সার্টিফিকেট তুলতে পারে তখন কিছু করার নাই। পাসপোর্টেও সেই ভুলটাই যাবে।”
সম্প্রতি বহু নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন।
গত ৩০শে অক্টোবর নদী আক্তারের লাশ গ্রহণ করে তার পরিবার।
সৌদি আরব পাঠানোর সময় নদীর বয়স তার মা ১৭ বছর বলে দাবি করলেও পরিবারের কাছে থাকা জন্ম নিবন্ধন সনদ অনুযায়ী নদীর জন্ম ২০০৭ সালে। সেই হিসেবে এখনও নদী আক্তারের ১৩ বছর পূর্ণ হয়নি।
মেয়েটির স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লায় দেয়া থাকলেও এই জন্ম সনদ তোলা হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জোন -২ থেকে।
স্কুলে ভর্তির উদ্দেশ্যে মেয়ের বাবা এই সার্টিফিকেট তৈরি করেছিল বলে জানান মেয়েটির মা বিউটি বেগম।
তবে মেয়েটির প্রকৃত বয়স ১৩ হোক বা ১৭- অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে তার জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার কথা না।
জন্ম নিবন্ধন সনদ দেখিয়েই তার পাসপোর্ট করানোর কথা।
কিন্তু পাসপোর্টে নদী আক্তারের বয়স বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে ২৭ বছর।
এজন্য পাসপোর্ট অফিসে জমা দেয়া হয়েছে নতুন আরেকটি জন্ম সনদ। সেখানে জন্ম দেখানো হয়েছে ৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৩। সনদটি ইস্যু করা হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জোন-৪ থেকে।
সৌদি আরবে গৃহকর্মি হিসেবে যাওয়া বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের দেশে ফেরার প্রবণতা বাড়ছে।
একাধিক ভুল তথ্য দিয়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করার কারণেই পাসপোর্টে ভুল যুক্ত হচ্ছে বল জানান মি. চৌধুরী।
এরমধ্যে বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৫ হাজার পাসপোর্ট প্রিন্ট হওয়ায় এরমধ্যে কিছু কিছু পাসপোর্টের তথ্যের গড়মিল ধরা কঠিন হয়ে যায় বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “প্রতিদিন ২৫ হাজার পাসপোর্টের মধ্যে ১ শতাংশেও যদি সমস্যা থাকে তাও ২৫টা পাসপোর্ট হয়। সেই ভুলগুলোই সামনে আসছে। আমাদেরও মেয়েটিকে দেখে তার প্রকৃত বয়স ধারণা করা উচিত ছিল। এমন কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল হচ্ছে।”
জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের তথ্য একই সার্ভারের আওতায় চলে এলে তথ্যের এই বিভ্রান্তি দূর করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে কুলসুম নামে এক কিশোরীর লাশও সৌদি আরব থেকে ফেরত এসেছিল। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার সনদ অনুযায়ী তার বয়স ১৪ বছর হলেও পাসপোর্টেও বয়স দেখানো হয় ২৭ বছর।
কিন্তু সৌদি আরবে ২৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের পাঠাতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় রিক্রুটিং এজেন্সি তার বয়স বেশি দেখিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে।
কিন্তু দেড় বছরের মাথায় দুটি মেয়েকেই লাশ হয়ে দেশে ফিরতে হয়।
এ ব্যাপারে নদী আক্তারের মা বিউটি বেগম বলেন, “আমার মেয়ের অরিজিনাল বয়স ১৭ বছর ছিল, ওরা ২৭ বছর লেইখা পাঠাইসে। যে অফিসের মাধ্যমে আমার মেয়ে বিদেশে গেসে ওরাই জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট করসে। বয়স বাড়াইসে। সব ওরাই করসে।”
এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলোর জবাবদিহিতা না থাকা এবং সৌদি আরবের দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে তথ্যে গড়মিল করার এই প্রবণতা ঠেকানো যাচ্ছে না বলে জানান রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, “সৌদি আরব নারীদের কাজের জন্য আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ। আর কমবয়সী মেয়েদের জন্য তো বটেই। এক্ষেত্রে শুধু রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করলে হবে না। বরং এর সঙ্গে প্রশাসনের সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এছাড়া সৌদি আরবে যারা এই কম বয়সী মেয়েদের নিয়োগ দিয়েছে। তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা জরুরি।”
সুত্র : বিবিসি