স্পটলাইট

ফিরে আসছে উদয়ী পাকরা ধনেশ

বিশাল বড় ঠোঁটের জন্য সহজেই আলাদা করা যায় ধনেশ পাখিকে। ধনেশ পাখির মাঝে উদয়ী পাকরা ধনেশ দেখতে সুন্দর। এই পাখির বিশেষত্ব হলো- বড় ও সুন্দর ঠোঁট। এটি দিয়ে সে খাদ্য সংগ্রহ, বাসা তৈরিসহ সকল কাজ করে থাকে। প্রকৃতির অনন্য এই সুন্দর পাখিটি আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল। কারণ এর আবাস এবং খাদ্যের সংস্থান ধ্বংস করা হয়েছে। শিকারীরা একে মানুষের খাদ্যে পরিণত করেছে। তবে হবিগঞ্জের দুটি জাতীয় উদ্যান রেমা-কালেঙ্গা ও সাতছড়িতে এই পাখির দেখা মিলছে। ওই দুই বনের এটি সূচক পাখি। বিশেষ করে সাতছড়িতে উদয়ী পাকরা ধনেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে পাখি শুমারির তথ্যে জানা গেছে।
সম্প্রতি পাখি শুমারী থেকে জানা যায়, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বাড়ছে সূচক পাখি। বনে থাকা ১১টি সূচক পাখির শুমারীর মাধ্যমে এই তথ্য পাওয়া গেছে। বিষয়টি জানতে এবং স্বচক্ষে পরিদর্শন করতে আসেন নাসার এক বিজ্ঞানীসহ আমেরিকান ফরেস্ট সার্ভিসের ৪ সদস্য। পরিদর্শন দলের মাঝে উপস্থিত ছিলেন নাসার বিজ্ঞানী ন্যাথান থমাক, আমেরিকান ফরেস্ট সার্ভিসের কর্মকর্তা কলিন মেসটন, চিপস কট, হিথার হেইডেন, জাস্টিন ব্রিক, বাংলাদেশে আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তা পেট্রিক ম্যায়র।
তারা পরিদর্শন করে সূচক পাখি বৃদ্ধির বিষয়টি জানতে পেরে মুগ্ধ হন। বিষয়টি মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। মিডিয়ায় প্রতিবেদন দেখে আগ্রহী হয়ে উঠেন হবিগঞ্জের তরুণ ফটোগ্রাফার এবং শখের ছবিয়ালের এডমিন আশিস দাস। তিনি ছুটে যান সাতছড়িতে। এবং ঠিকই তার ক্যামেরায় পাকড়াও হয় উদয়ী পাকরা ধনেশ।
আশিস দাস জানান, বন্যপ্রাণী ও পাখপাখালির ছবি তুলতে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে আমার যাতায়াত প্রায় ৬ বছর ধরে। বছর দেড়েক ধরে অনিয়মিত। বনে বিভিন্ন পশু পাখির ছবি পেলেও উদয়ী পাকরা ধনেশ খুব একটা চোখে পড়েনি। একবার জেনেছিলাম ২/৩টি পাখি হয়তো বা বনে আছে। পত্রিকায় সংবাদ দেখে ছুটে যাই বনে। সেখানে ঠিকই দেখা পেয়েছি উদয়ী পাকরা ধনেশের। এনিয়ে ধনেশের দেখা পেয়েছি দু’বার। ইদানিংকালে সর্বোচ্চ ১৪টি উদয়ী পাকরা ধনেশের একটা দল দেখা পাবার তথ্য পেয়েছ সেখানে। বছর খানেক আগে জঙ্গলের গহীনে একটা বাচ্চাসহ একজোড়া ধনেশের দেখা পেয়েছিলাম। কিন্তু জীবনের প্রথম প্রিয় পাখির দেখা তাই উত্তেজনাবশত শাটার চালাতে পারিনি। হা করে ওদের উড়ে যাওয়া দেখছিলাম।
গত কয়েকদিনে আগে উদ্যানে গিয়ে ডরমেটরির পাশে চায়ের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার করেছি ঠিক তখনি আমাকে অবাক করে দিয়ে খুব কাছ দিয়ে উড়ে এসে ফুলে ফুলে সুশোভিত কৃষ্ণচূড়ায় বসলো ধনেশ। একটা দুটি নয়, দুটি বাচ্চাসহ ছয় ছয়টা ধনেশ। ওরা নাকি নিয়মিতই আসে এখন। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা আশাব্যাঞ্জক হলেও আসলে এটা এই প্রজাতির ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট হতাশার। তবে প্রথমবার শাটার চালানোর সুযোগ মিস হলেও এবার আর মিস হয়নি। প্রত্যাশিত ছবি নিয়েই ফিরতে পেরেছি আমি।
আশিস দাস জানান, ধনেশ উচু ডালের পাখি এবং এরা স্বভাবে লোকালয় এড়িয়ে চলা প্রজাতি। প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি আমাদের খামখেয়ালিপনা ও নিষ্ঠুর আচরণের ফলস্বরূপ ধনেশের মতো বিচিত্র সব প্রজাতি তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। এতে করে এদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং দিনে দিনে বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে। বৃহদাকার গাছের মরা খোলসের পোকামাকড় ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ফলমূল থাকার কথা তাদের খাদ্যাভ্যাসে। কৃষ্ণচূড়ার কলি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করার কথা না এই সুন্দর পাখিটির। গাছগাছালি নষ্ট হওয়াতে শুধুমাত্র পেটের তাগিদেই লোকালয়ে আসতে হচ্ছে ওদের। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই তবে একদিন শুধু ছবিগুলোই থাকবে আর সাথে একরাশ আফসোস।
ক্লাইমেট-রেজিলিয়েন্ট ইকোসিস্টেমস্ এন্ড লাইভীহুডস (ক্রেল) প্রকল্পের সাইট ফ্যাসিলিটেটর আব্দুল¬াহ আল মামুন জানান, পাখি শুমারীতে এই বনের ১১টি সূচক পাখি বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মাঝে উদয়ী পাকুরা ধনেশও রয়েছে। এই পাখির বৃদ্ধি প্রমাণ করে বনের পরিস্থিতি ভাল আছে। বনের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পরিমাপের মাপকাটি জল এই সূচক পাখি।
ক্লাইমেট-রেজিলিয়েন্ট ইকোসিস্টেমস্ এন্ড লাইভীহুডস (ক্রেল) প্রকল্পের রেমা-কালেঙ্গা সাইট ফ্যাসিলিটেটর আনোয়ার হোসেন জানান, রেমা-কালেঙ্গায় এক সময় উদয়ী পাকরা ধনেশ প্রচুর ছিল। কিন্ত সাম্প্রতিককালে এটি বিপন্ন হয়ে পড়ে। এক সময় রেমা-কালেঙ্গায় এই পাখির দেখা মিলত না। তবে ইদানিং বনে এই পাখির অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বিশিষ্ট পাখি আলোকচিত্রী জালাল আহমেদ জানান, সাতছড়িতে উদয়ী পাকরা ধনেশ এর আবাসস্থল। তিনি সেখানে অনেকবার ছবি তুলতে গেলেও এই পাখির ছবি সেখান থেকে তোলা হয়নি। তবে সেখানে পাখিটি বাড়ছে জেনে তিনি আনন্দিত।
সরকারি বৃন্দাবন কলেজের সহকারী অধ্যাক সুভাষ চন্দ্র দেব জানান, পৃথিবীব্যাপী ধনেশের প্রজাতি ৫৬টি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মিশ্র চিরহরিৎ বনে প্রতিকুল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে এখনো টিকে আছে ৪টি প্রজাতি। এগুলো হলো পাতাঠুঁটি ধনেশ, উদয়ী পাকরা ধনেশ, রাজ ধনেশ ও দেশি মেটে ধনেশ। উদয়ী পাকরা ধনেশ কে কাও ধনেশ বা কাউ ধনেশও বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম ধহঃযৎধপড়পবৎড়ং ধষনরৎড়ংঃৎরং এবং ইংরেজি নাম ঙৎরবহঃধষ ঢ়রবফ যড়ৎহনরষষ। এরা বাংলাদেশের স্থায়ী পাখি। চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে পাওয়া যায়। আই ইউ সি এন এটিকে আশংকাহীন ঘোষণা করলেও বাংলাদেশে এটি বিপন্ন বলে বিবেচিত। সরকারের বন্যপ্রাণী আইনে এটি সংরক্ষিত।
উদয়ী পাকরা ধনেশের উপরের দিক চকচকে কালো রঙের, নিচের দিক সাদা। ডানার ওড়ার পালকের ডগা এবং লেজের বাইরের পালকের আগার দিক সাদা। গলায় পালকহীন নীল চামড়ার পট্টি থাকে। চোখের চারপাশে ও গলায় নীলাভ-সাদা চামড়া দেখা যায়। পা ও পায়ের পাতা স্লেট রঙের সবুজ। চোখের তারা লালচে। নিচের দিকে বাঁকানো বড় ঠোঁটের উপরের বর্ম মাথার পেছনের দিকে বেশি প্রলম্বিত কিন্তু সামনের দিকে একটু বাড়ানো ও এক ডগাযুক্ত। স্ত্রী ধনেশ যে কেবল আকারে ছোট তাই নয় তাদের বর্ম পর্যন্ত ছোট এবং এর ঠোঁটের উপর কালোর ছোপ বেশি আর নিচের ঠোঁটের গোড়ায় লালচে অংশ আছে। তাছাড়া এর চোখও বাদামী। এই ধনেশ দৈর্ঘ্যে কমবেশি ৯০ সেন্টিমিটার।
ধনেশ সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় থাকে। এক জোড়া একই এলাকায় বছরের পর বছর থাকতে পছন্দ করে।কখনও সঙ্গে অপরিণত ছানাও থাকতে পারে। বনের বটজাতীয় গাছের যখন ফল পাকে, তখন অন্য অনেক প্রজাতির পাখি ও স্তন্যপায়ীদের সাথে মিলে সে খাবারে হামলা চালায়। বনের ছোট বড় সকল নরম ফল খেতে পারদর্শী, সেই সাথে খেয়ে থাকে পাখির ছানা, ডিম, ইঁদুর, ব্যাঙ, সরিসৃপ প্রভৃতি।
বাসস

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button