মো. নজরুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : আজ বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের ১৪২তম জন্মদিন ও ৯০তম মৃত্যু দিবসে আত্মার শান্তি কামনা করছি ও তার আদর্শের পথ ধরে ধর্মান্ধতা মৌলবাদ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাহসী কলম বয়ান ও সংক্ষিপ্ত কর্মের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। আজ ০৯ ডিসেম্বর নারী জাগরণের সর্বকালের পথপ্রদর্শক, মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার ১৪২তম জন্মবার্ষিকী এবং ৯০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এপার ও ওপার বাংলাতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি পালিত হবে। তিনি বালাদেশের রংপুররের পায়রাবন্দে ১৮৮০ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩২’সালের এই দিনে ভারতের কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন একাধারে ছিলেন চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞানের কল্পকাহিনী ও শ্লে¬ষাত্মক রচনায় রোকেয়ার স্টাইল ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। উদ্ভাবনা, যুক্তিবাদিতা এবং কৌতুকপ্রিয়তা তাঁর রচনার সহজাত বৈশিষ্ট্য। তাঁর প্রবন্ধের বিষয় ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত বিজ্ঞান সম্পর্কেও তাঁর অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন রচনায়। মতিচূর (১৯০৪) প্রবন্ধগ্রন্থে রোকেয়া নারী-পুরুষের সমকক্ষতার যুক্তি দিয়েছেন। নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন এবং শিক্ষার অভাবকে নারী পশ্চাৎপদতার কারণ বলেছেন। তাঁর সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৫) নারীবাদী ইউটোপিয়ান সাহিত্যের ক্লাসিক নিদর্শন বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। অবরোধ-বাসিনীতে (১৯৩১) তিনি অবরোধ প্রথাকে বিদ্রূপবাণে জর্জরিত করেছেন।
রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর পিতা জহীরদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের জমিদার ছিলেন। মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়। পিতা আবু আলী হায়দার সাবের আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। রোকেয়ার বড় দু’ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের ছিলেন বিদ্যানুরাগী। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়ন করে তাঁরা আধুনিকমনস্ক হয়ে ওঠেন। বেগম রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনে বড় দু’ভাই ও বোন করিমুন্নেসার যথেষ্ট অবদান ছিল।
তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের গৃহের অর্গলমুক্ত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোন সুযোগ ছিল না। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাস করার সময় একজন মেম শিক্ষাত্রীর কাছে বেগম রোকেয়া কিছুদিন লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয় স্বজনদের ভ্রুকুটির জন্য তাও বন্ধ করে দিতে হয়। তবু রোকেয়া দমে যাননি। বড় ভাই-বোনদের সমর্থন ও সহায়তায় তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি এবং আরবি ভাষা আয়ত্ত করেন।
সাহিত্যিক হিসেবে বেগম রোকেয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯০২ সালে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘নভপ্রভা’ পত্রিকায় ছাপা হয় ‘পিপাসা’। বিভিন্ন সময়ে তাঁর রচনা নানা পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। ১৯৫০ সালে প্রথম ইংরেজি রচনা ‘সুলতানাজ ড্রিম’ মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ছাপা হয়। সবাই তাঁর রচনা পছন্দ করেন। তিনি তখন থেকে সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন। তারপর ১৮৯৮ সালে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয়ে বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মহান মানুষ। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তবে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। ইতোমধ্যে তাঁদের দুটি কন্যাসন্তান জন্ম নিয়ে অকালেই মারা যায়। তারপর তিনি স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ রোকেয়া নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর স্বামী প্রদত্ত অর্থে পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে তিনি ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু পারিবারিক কারণে তিনি ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে তিনি নবপর্যায়ে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৬ সালের মধ্যে ছাত্রীসংখ্যা একশত পেরিয়ে যায়। স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন, যা সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ছিলো দুঃসাহসিক কাজ।
তারপর বেগম রোকেয়া তাঁর নারীবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন মতিচূর প্রবন্ধসংগ্রহের প্রথম (১৯০৪) ও দ্বিতীয় খন্ডে (১৯২২)। সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৫), পদ্মরাগ (১৯২৪), অবরোধবাসিনী (১৯৩১) ইত্যাদি তাঁর সৃজনশীল রচনা। তাঁর ‘সুলতানার স্বপ্ন’কে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে মাইলফলক ধরা হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার আগে তাঁর লেখাগুলো নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। রচনা দিয়ে তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না, তাও বলেছেন। বেগম রোকেয়া অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক বিবেচনা করেছেন এবং নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থ- রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
বেগম রোকেয়ার সমাধি, পাণিহাটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রঙ্গন, সোদপুর, কলকাতায়। তিনি ১৯৩২ সালের ০৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন। তাঁর কবর উত্তর কলকাতার সোদপুরে অবস্থিত, যা পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অমলেন্দু দে আবিষ্কার করেন। রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় ৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর ২০০৯ সালে ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে তাঁর নামকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ নামকরণ করা হয়। নারীর নামে বাংলাদেশে প্রথম কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এটি। বেগম রোকেয়ার নামে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬০-এর দশকে ছাত্রীনিবাস ‘রোকেয়া হল’ খোলা হয়, যার নাম আগে ছিল ‘উইমেন্স হল’ তবে ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৮ সালে ‘চামেলি হাউজ’ নামে হলটি চালু হয়েছিলো।
উল্লেখ্য যে ১৯৮০ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। তাঁর ১৩৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুগল তাদের হোমপেজে বেগম রোকেয়ার গুগল ডুডল প্রদর্শন করে তাঁর জন্মদিন উদযাপন করে। গুগল ডুডলটিতে দেখা যায়, সাদা পোশাকে চশমা পরা বেগম রোকেয়া বই হাতে হেঁটে যাচ্ছেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্মরণে বাংলাদেশ সরকার একটি গণউন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে পৈতৃক ভিটায় ৩ দশমিক ১৫ একর ভূমির ওপর নির্মিত হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র। এতে অফিস ভবন, সর্বাধুনিক গেস্ট হাউজ, ৪ তলা ডরমেটরি ভবন, গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরি ইত্যাদি রয়েছে। মহিয়সী বাঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসনের জন্য একটি আবাসিক হলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণ করা হয়। প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিনে বেগম রোকেয়া দিবস পালন করা হয় এবং নারী উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য বিশিষ্ট নারীদেরকে বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়।
পরিশেষে বলতে হয়, বেগম রোকেয়ার পথ ধরে দেশে নারী শিক্ষার সংখ্যাগত উন্নয়ন হলেও তার প্রগতির আদর্শের পথে গুণগত শিক্ষার উন্নয়ন হ্রাস পেয়েছে। আজ থেকে দেরশত বছর আগে তিনি তার সুলতানার স্বপ্নে ধর্মীয় কুসংস্কার অন্ধ গোড়ামী ও বাঙ্গালী সংস্কৃতির পোষাক পরে অন্দর মহল ছেড়ে নারীকে বের করেছিলেন। সেই নারী আজ অনন্দর মহলের বাইরে থাকলেও ভিনদেশীয় হিজাবী সংস্কৃতি দ্বারা চরমভাবে আক্রান্ত। বর্তমানে আমাদের ছেলে মেয়েরা পুথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত হলেও প্রগতিশীল নারীবান্ধব সংাস্কৃতিক চর্চায় অনেক দূর পিছিয়ে আছে। তাই আসুন আমরা সচেতন শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজে নারী পুরুষে বৈষম্য দুর করে বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক সমাজের পথ সুগম করি। মো. নজরুল ইসলাম: লেখক ও উন্নয়নকর্মী,