sliderধর্মশিরোনাম

পাগলা মসজিদে ১১০ দিনেই মিলল ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা

কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দানবাক্স থেকে ১১০ দিনেই পাওয়া ৬ কোটি ৩২ লাখ ৫১ হাজার ৪২৩ টাকা।এ মসজিদের ইতিহাসে দানবাক্স থেকে পাওয়া এটিই সর্বোচ্চ পরিমাণ টাকা।

নগদ টাকা ছাড়াও প্রতিবারের মতো এবারো দানবাক্সে মিলেছে বিদেশী মূদ্রা ও সোনা-রূপার বিপুল অলঙ্কার। অলঙ্কারের পরিমাণ প্রায় চার কেজি হয়েছে বলে জানা গেছে।

টাকা গণনা শেষে শনিবার (৯ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মহুয়া মমতাজ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে সকাল সা‌ড়ে ৭টার দি‌কে জেলা প্রশাসক ও মস‌জিদ ক‌মি‌টির সভাপ‌তি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজা‌দ ও পু‌লিশ সুপা‌রের মোহাম্মদ রা‌সেল শে‌খের তত্ত্বাবধা‌নে মস‌জি‌দের নয়‌টি সিন্দুক খোলা হয়।

টাকা গণনা কাজে মাদ্রাসার ১১২ জন ছাত্র, ব্যাংকের ৫০ জন স্টাফ, মসজিদ কমিটির ৩৪ জন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১০ জন সদস্য অংশ নেন। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এ.টি.এম ফরহাদ চৌধুরী, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর শেখ জাবের আহমেদ, সহকারী কমিশনার রওশন কবীর, মাহমুদুল হাসান, সামিউল ইসলাম, আজিজা বেগম, মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি খলিলুর রহমান ও রূপালী ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) রফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে গত ১৯ আগস্ট খোলা হ‌য়ে‌ছিল মস‌জি‌দের সিন্দুকগু‌লো। তখন পাওয়া যায় ৫ কো‌টি ৭৮ লাখ ৯ হাজার ৩২৫ টাকা। তারও আগে মে মাসের ৬ তারিখে খোলা হয়েছিল সিন্দুক। তখন মিলেছিল ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯টাকা। জানুয়ারি মাসেও পাওয়া যায় ৪ কোটিরও বেশি টাকা।

স্থানীয়রা জানায়, এ মসজিদের দানবাক্স খুললেই পাওয়া যায় কয়েক কোটি টাকা। এ কারণে মসজিদের দানবাক্সে কী পরিমাণ টাকা পাওয়া গেল, তা নিয়ে লোকজনের থাকে অনেক কৌতুহল। তাই গণনা শেষে প্রতিবারই জানিয়ে দেয়া হয় টাকার অঙ্ক।

তবে স্থানীয়রা অনেকে বলেছেন, স্বচ্ছতার স্বার্থে আয়ের পাশাপাশি মসজিদের টাকা-পয়সা ব্যয়ের হিসাবটাও জনসম্মুখে নিয়মিত প্রকাশ করা উচিত। এছাড়াও প্রতিদিন মসজিদটিতে কুরআন মজিদ, মোমবাতি, গবাদি পশু, গাছের ফলফলাদি ইত্যাদি মানত হিসেবে দান করা হয়। এগুলোর হিসাব মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে কোনো সময়ই প্রকাশ করা হয় না। এগুলো বিক্রির টাকার হিসাব জনসম্মুখে নিয়মিত প্রকাশ করারও দাবি এলাকাবাসীর।

শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কঠোর নিরাপত্তায় খোলা হয় মসজিদের সব সিন্দুক। এরপর টাকাগুলো বস্তাবন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় দোতলায়। টাকাগুলো ভরতে ২৩টি বস্তার প্রয়োজন হয়। বস্তাগুলো খুলে টাকাগুলো মেঝেতে রেখে যখন গণনা করা হয় এ বিরল দৃশ্যের ছবি বা ভিডিও ধারণ করতে শহরের শত শত মানুষ জড়ো হয়।

স্থানীয়রা জানায়, মুসলমান ছাড়াও অন্য ধর্মের লোকজনও এ মসজিদে দান করে থাকে। এখানে দান করলে মনোবাসনা পূরণ হয় এমন বিশ্বাস থেকে মানুষ ছুটে আসে পাগলা মসজিদে। এ মসজিদের দানবাক্সে যে বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়, তা দেশের আর কোনো মসজিদে মিলে না। টাকার সাথে সোনা-রূপার অলঙ্কারসহ থাকে বিদেশী মূদ্রাও। তাছাড়া প্রতিদিন বিপুল সংখ্যাক গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, ফলফলাদি, মোমবাতি ও ধর্মীয় বই দান করে থাকে লোকজন।

আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় দানবাক্সে পাওয়া চিঠিপত্র। এসব চিঠিতে লোকজন তাদের জীবনে পাওয়ার আনন্দ, না-পাওয়ার বেদনা, আয়-উন্নতির ফরিয়াদ, চাকরির প্রত্যাশা, পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের আশা ও রোগব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে আকুতি প্রকাশ করে। এমনকি শত্রুকে ঘায়েলের দাবিও থাকে কোনো কোনো চিঠিতে।

সকালে দানবাক্স বা সিন্দুক খোলার সময় মসজিদে নেয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। জেলা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বড়সড় দল টাকা-পয়সা গণনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন।

সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সিন্দুকের টাকা-পয়সা বস্তাবন্দী করছে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন। পরে বস্তাগুলো ধরাধরি করে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অপেক্ষমান গণনাকারীদের সামনে ঢেলে দেয়া হয় টাকাগুলো। এভাবেই শুরু হয় গণনার কাজ।
পাগলা মসজিদের টাকা জমা হয় রূপালী ব্যাংকে। তাই এই ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারি, মসজিদের কর্মচারি ও কমিটির লোকজন, মাদরাসার ছাত্রসহ সবমিলিয়ে দু-শাতাধিক লোক সারাদিন টাকা গণনার কাজে ব্যস্ত থাকে।

মসজিদ পরিচালনা, এর অর্থ-সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় ২৯ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে আছে যথাক্রমে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র।

জানা গে‌ছে, মসজিদের দানের টাকা গচ্ছিত থাকে রূপালী ব্যাংকে। আর ওই টাকার লভ্যাংশ থেকে গরিব অসহায় লোকদের আর্থিক সহায়তা, ক্যানসারসহ জটিল রোগে আক্রান্তদের আর্থিকভাবে অনুদান দিয়ে মসজিদটি আর্তমানবতার সেবায় ভূমিকা রাখছে। দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনুদান দেয়া হয় মসজিদের তহবিল থেকে। এইসব সেবামূলক কর্মকাণ্ড সারাবছরই করে থাকে পাগলা মসজিদ।

মসজিদ পরিচালনা ক‌মি‌টি জানায়, কেবল মুসলমান নয়, অন্য ধর্মের লোকজনও পাগলা মসজিদে বিপুল অঙ্কের টাকাপয়সা দান করে। সব সম্প্রদায়ের মানুষ পাগলা মসজিদ পরিদর্শনে আসে। যা প্রকৃতপক্ষে অসাম্প্রদায়িকতার বিরল এক দৃষ্টান্ত।

মসজিদের সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দানের টাকায় মসজিদের বড়সড় উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। মসজিদ ঘিরে এখানে আন্তর্জাতিকমানের একটি দৃষ্টিনন্দন বহুতল ইসলামি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। সমৃদ্ধ লাইব্রেরিসহ থাকবে আরো বিভিন্ন আয়োজন। এ প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে ১১৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শেষের পথে। এখন সবকিছু গুছিয়ে আনা হচ্ছে। খুব শিগগিরই হয়ত কাজে হাত দিতে পারব আমরা।’

কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিমে হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে মাত্র ১০ শতাংশ ভূমির ওপর এই মসজিদটি গড়ে উঠেছিল। সময়ের সাথে আজ পাগলা মসজিদের পরিধির সাথে বেড়েছে খ্যাতিও।
নয়া দিগন্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Back to top button