শাহীন রাজা : পশ্চিম বঙ্গে এবার নতুন রাজনৈতিক পার্টনার। যা তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয় তরণীতে ঢেউ জোগাবে। নতুন পার্টনার হচ্ছে, পশ্চিম বঙ্গের মুসলমান গোষ্ঠী। এবারের ভোটে তারা হবে “ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর”।
এই বিবেচনায় এবারের নির্বাচনে-ও, তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। মমতা’র দলকে একাধারে বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেসের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। তবে গত ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ তৃণমূলের বিরোধিতা করে বিজেপি’র পক্ষ নেয়। এবারের নির্বাচনে তাদের এর জন্য খেসারত দিতে হতে পারে। এদিকে গোটা ভারতে বিজেপি বিরোধী যে ঢেউ উঠেছে, তা কংগ্রেস কিংবা সিপিএমের পক্ষে যাচ্ছে না।
গত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিম বঙ্গে ৪২ আসনের মধ্যে, তৃণমূল কংগ্রেস পায় ২২। অপরদিকে বিজেপি লাভ করেছিল ১৮টি আসন। গত নির্বাচনে বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেসের কাছাকাছি থাকলেও। ২০২১ সালের বিধানসভার নির্বাচনে ফলাফল পুরোটাই মমতা’র দলের পক্ষে। গত বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪টি আসনের মধ্যে, তৃণমূল কংগ্রেস লাভ করে ২১৫টি।
বলা হয়ে থাকে, পশ্চিম বঙ্গের নির্বাচন নির্ধারণ করে ভোট। এই ভোট এক সময় কংগ্রেসের পক্ষে ছিল। কংগ্রেসের সস্তা ধর্ম নিরপেক্ষ শ্লোগানের প্রতি মুসলিম ভোটার’রা একসময় আস্থা হারায়।
পরবর্তীতে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন দল সিপিএম মুসলিম ভোটারদের আস্থা অর্জন করে। এরপর দীর্ঘ সময়। সিপিএম-এর ভূমি এবং আর্থিক সংস্কার ফলে মুসলমানদের হাতে নগদ অর্থের সমাগম ঘটে। এবং তাঁদের লক্ষ্য আরো বিস্তৃত হয়। সিপিএম প্রগতির কথা বললেও, রাজনৈতিক রক্ষণশীলতা তাঁদের সামনে বাড়তে দেয় না। সিপিএম মুসলমানদের জীবন মানের পক্ষে ছিল কিন্তু এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হোক এটা তারা মানতে পারেনি। মমতা’র তৃণমূল সেই স্বপ্ন দেখায়। এবং মুসলমান ভোটাররা মমতা’র দিকে ভীড়ে যায় !
মুসলমান ভোটাররা মমতা’র দিকে ভীড় জমানো নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ভিন্ন ! তাঁরা মনে করেন, ১৯৪৭ সালে বিভক্তির সম্ভ্রান্ত বা বর্ধিষ্ণু এবং শিক্ষিত মুসলমানরা পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। এবং পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস শুরু করে। কিন্তু তুলনামূলক অনগ্রসর অংশ পশ্চিম বঙ্গে থেকে যায়। তারা মূলত কৃষক এবং ছোটখাটো নিম্ন আয়ের ব্যবসায়ী। এমনকি তাঁদের শিক্ষার হার ছিল খুবই নগন্য। তাঁরা ভারতের মাটিতে থেকে যায়।
ভারত বিভক্তির পর,পশ্চিম বঙ্গে অবস্থান নেয়া মুসলমান গোষ্ঠী নিজেদের নিরাপদ নিয়ে শঙ্কিত ছিল। নেহেরু’র নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস মুসলমানদের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয়। এবং দীর্ঘ সময় পশ্চিম বঙ্গেে মুসলমান’রা কংগ্রেসের সাথে চলে।
একসময় মুসলমানরা লক্ষ্য করে দেশ ভাগ হওয়ার সময় তাদের অবস্থা যেমনটা ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। কোন পরিবর্তন নেই। অথচ দেশের সবক্ষেত্রেই পরিবর্তন এবং উন্নতি হচ্ছে। কংগ্রেসের প্রতি মুসলমান সম্প্রদায় হতাশ হয়ে ওঠে। খোঁজে বিকল্প রাজনৈতিক দল।
এমন সময় জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বাম রাজনৈতিক দল সিপিএম মুসলমানদের হৃদয়ে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। কংগ্রেসের উপর আস্থা তুলে নিয়ে সিপিএম-এর দিকে ঝুকতে থাকে। একসময় মুসলমানদের বিশাল অংশ সিপিএম-এর সমর্থক হয়ে ওঠে। এবং সিপিএম টানা তিন দশক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পশ্চিম বঙ্গে রাজত্ব চালায়। নির্বাচিত হয় !
সিপিএম রাজ্যে সাধারণ মানুষের জন্য আর্থিক, ভূমি এবং কৃষি সংষ্কার করে। পশ্চিম বঙ্গের সনাতনী ধর্মাবলম্বীর ছোটখাটো ব্যবসা কিংবা কৃষি কাজ থেকে সরকারি বা বেসরকারি চাকুরী পছন্দ করতো। তাই এই সংষ্কারে প্রথম লাভবান হয় মুসলমান সম্প্রদায়। এবং তাঁরা ধীরে, ধীরে আর্থিক উন্নতি ঘটতে থাকে। আর্থিক সংগতি সৃষ্টি হওয়ায় পশ্চিম বঙ্গের সামাজিক কাঠামোতে তাঁদের অবস্থান সুসংগঠিত হয়। এরপর তাঁরা, আর্থিক সুবিধা’র সাথে সাথে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অংশীদার লাভের আশার সঞ্চার ঘটে।
তৃণমূল কংগ্রেস, আশার সেই দরজা খুলে দেয়। গত কয়েক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পশ্চিম বঙ্গের মুসলমানরা নির্বাচন করে। এবং রাজ্য সরকারের আর্শীবাদ থাকায় তাঁরা বিজয়ী-ও হয়।
মুসলমান’রা ক্রমশই রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠছে, মমতা’র সরকারের আমলে। এখন আর পশ্চিম বঙ্গের মুসলমান’রা ভোট ব্যাঙ্ক নয়। এখন তাঁরা শক্তিশালী রাজনৈতিক পার্টনার।
লেখক,সিনিয়র সাংবাদিক