মো.নজরুল ইসলাম,মানিকগঞ্জ: ভূমিকা: আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশে^র নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, “অন্তত পক্ষে বালিকাদিগকে প্রাথমিক শিক্ষাটা দিতেই হইবে। শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি। গোটাকতক পুস্তক পাঠ করিতে বা দুছত্র কবিতা লিখিতে পারা শিক্ষা নয়। আমি চাই সেই শিক্ষা যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে, তাহাদিগকে আদর্শ কন্যা, আদর্শ গৃহিণী এবং আদর্শ মাতৃরূপে গঠিত করিবে।“ এ রচনার শুরুতেই এ মহীয়সী নারীর বাণীকে এ হিসেবেই উপস্থাপন করা হল যে, নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে মনে প্রাণে তিনিই উপলব্ধি করে নারীবান্ধব শিক্ষা ও সমাজের পথ দেখিয়েছিলেন।
চিরন্তন সত্য যে, নারীরা আমাদের সমাজেরই অর্ধেক অংশ। অর্ধেক অংশকে অন্ধকারে রেখে অন্য অংশ আলোকিত করতে চাইলে গোটা সমাজ কোনোদিনই কি আলোকিত হবে? তাহলেতো গোটা পৃথিবীতে একই সাথে দিবারাত্র সংঘটিত হতো। এত বড় সূর্য ও সমগ্র পৃথিবীকে একই সাথে আলোকিত করতে পারছে না। তাই নারীসমাজকে বাদ দিয়ে সমাজের উন্নয়ন তথা জাতি বা রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাহলে মোদ্দাকথা হল এই যে, সমাজের অর্ধাংশ নারীকে শিক্ষার আলোকে উদ্ভাাসিত করেই, সমাজ তথা জাতির উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে।
নারীবান্ধব শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানব জীবনে পরিপূর্ণ সফলতার ইচ্ছা শক্তিতে নারী শিক্ষার গুরুত্ব সর্বত্র স্বীকৃতি পেলেও যুগে যুগে,কালে-কালান্তরে পুরুষের অনুদার দৃষ্টিভঙি নারীকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে। তাদের কেউ কেউ মনে করেছেন, নারীর স্থান বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরে অন্তপুরের কারান্তরালে। আবার অন্যরা মনে করে থাকেন, নারী সমাজ শিক্ষিত হলে ঘরের কাজে অসুবিধার সৃষ্টি হবে তথা পুরুষের নিজের কাজে বাধার সৃষ্টি হবে। প্রাচীন মন্ত্রকারদের মন্তব্য, “পুত্রর্থে ক্রিয়তে ভার্যা। শিক্ষার আলোতে উদ্ভাাসিত নারীসমাজ কাজের তাগিদে বাইরে বের হলে পারিবারিক অশান্তি দেখা দিবে। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে উঠলে সংসার ভেঙে যাবে। সংসার জীবন পারিবারিক খন্ডসহ পর্দা নষ্ট হবে। এমন ধরনের সংকীর্ণ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙির কারণে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে নারীসমাজ।
অবশ্য ব্যতিক্রম যে দু একজন নেই তা নয়, তবে তা ছিটেফোঁটা। তারা স্বীয় প্রতিভা বলে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জ্ঞানবিজ্ঞানে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
কিন্তু পুরুষের পাশাপাশি নারীর স্থান বা ক্ষমতায়ন না হলে জাতীয় জীবনে মুক্তির আশা কম, বলতে গেলে নেই। কেননা উন্নতির আশা করতে গেলে শরীরের সবটুকু সুস্থ না থাকলে যেমন বলা যায় না সুস্থ আছি, তেমনি পুরো জাতিকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত না করে বলা যায় না উন্নতি করছি।
শিক্ষাক্ষেত্রে এখন নারীর পদচারণা দৃষ্টিনন্দন যোগ্য। একজন সুশিক্ষিত মাতা তার সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজ আদর্শে গড়তে পারে। কেননা ছেলেমেয়ের ওপর মায়ের প্রভাবই বেশি পড়ে। মায়ের কাছ থেকেই শিশু পারিবারিক পরিবেশে আচার-আচরণ, আদব-কায়দা শিক্ষার প্রথম পাঠ শিখে থাকেন। এক কথায় বলতে গেলে শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম ধাপটাই পার করে মা। এ ব্যাপারে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট খুবই মূল্যবান একটি কথা বলেছেন, “তোমরা আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও। আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিব।“ স্বাববলম্বী হবার ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার গুরুত্ব। পুরাকালে নারীরা সবকিছুর জন্যে তাদের স্বামীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে তারা ছিল অবহেলিত ও নির্যাতিত। তাদের সমুদয় কাজ গৃহাভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল। যুগের পরিবর্তনে, কালের বিবর্তনে আজ নারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিকা এডভোকেট, বৈমানিক এমন কি রাজনীতিতে
তাদের সরব পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। অনেক দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে নারী।
তাই আজ আর নারী অবহেলার নয়, কবি নজরুল একথার যথার্থ প্রতিদবনি উচ্চারণ করেছেন,
….সে যুগ হয়েছে বাসি,যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাক নারীরা আছিল দাসী।
আমাদের এই চোখ পোড়ানো আলোর দেশ, সেখানেও নারী শিক্ষার বহু অন্তরায় রয়েছে। প্রথম অন্তরায়ে শস্যের মধ্যে ভূত হচ্ছে ধর্মীয় কুসংস্কার ও শিক্ষিত সমাজে ভিনদেশীয় ধর্মীয় গোড়ামি। বর্তমানে যুক্ত হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। সঠিক নিরাপত্তার অভাবে কোনো পিতামাতা তাদের কন্যা সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। এ অবস্থা গ্রামীণ পরিবেশে আরো ব্যাপক ও মারাত্মক। এতে করে প্রচন্ডভাবে ব্যাহত হচ্ছে নারী শিক্ষার জয়যাত্রা। সরকারের সংশ্লিস্ট মহল অর্থাৎ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর অসচেতনতা ও অবহেলা নারী শিক্ষার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে যেটা বড় কথা,দেশের বিপুল সংখ্যক নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজগতে আনার জন্য যে বিশাল আয়োজন,যে বিশাল উদ্যোগ, যে বিশাল প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো দরকার তা আমাদের নেই।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, নারীবান্ধব শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া দেশে সম্মৃদ্ধি আসবে না। সে জন্য নারী শিক্ষা বিস্তারে কতিপয় কর্মসূচি গ্রহণ করা অতি জরুরি।
১. দেশে প্রয়োজনীয় ও আনুপাতিক হারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এবং আনুপাতিক শিক্ষার্থী হারে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
২. মেয়েদেরকে সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। স্কুলগামী ছাত্রী যেন কোনোভাবেই কোনো ভয়ভীতি বা নির্যাতনের শিকার না হয়। প্রয়োজনে নিশেষ পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৩. বয়স্ক নারীদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪. শিক্ষাগ্রহণে নারীদেরকে উৎসাহী করতে সরকারকে উপবৃত্তি চালু করতে হবে এবং যে উপবৃত্তি চালু আছে তার যথাযথ কাজে লাগে বা লাগানো হয় সে জন্য এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করতে হবে।
৫. নারী শিক্ষা বিস্তারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে, নারী শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তোলা, সরকার ও সংশ্লিস্ট মহলের উদার নীতি গ্রহণ করতে হবে এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৬.নারীবান্ধব শিক্ষা ও সমাজ বিনির্মাণে বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করে কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
স্কুল কলেজ ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে এক ধরনের জেন্ডার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। তারপরও আমাদের মনে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে জেন্ডার ভূমিকার পরিবর্তনের মাধ্যমে নারী পুরুষের মধ্যেকার বৈষম্য দূর হতে আর কত সময় লাগবে?
সরকার উপবৃত্তি প্রথার মাধ্যমে নারীবান্ধব প্রতিষ্ঠান ও সমাজ বিনির্মানে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। তাদেরকে শিক্ষার ব্যপারে প্রলুদ্ধ করতে পারলে কিছুটা হলেও উৎসাহিত হবে।
এক্ষেত্রে উপবৃত্তি নিঃসন্দেহে গুরুত্ব বহন করবে। বিদ্যালয়ে গেলে যদি পড়তে পয়সা না লাগে, উপরন্তু বিদ্যালয়ে পড়তে গেলে যদি বেতন দেয়ার পরিবর্তে বেতন পাওয়া যায়, তাহলে মন্দ কি? বাড়িতে বসে থাকলেও হবে না। তাই উপবৃত্তি অনেকাংশে
উপকারে আসবে।
একটা ইংরেজি প্রবাদ এখানে উল্লেখ্য- ঞযব যধহফ ঃযধঃ ঢ়ঁষষং ঃযব পৎধফষব, ৎঁষবং ঃযব পড়ঁহঃৎু. যে শিশুর দোলনা ঠেলে, সে হস্ত রাজ্য শাসন করে।“ কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সতা। আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারছি, নারী শিক্ষার প্রসার ঘটানো অত্যন্ত জরুরি।
নারী শিক্ষা বিস্তারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থাবলি সত্যিই প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ সরকার নারী শিক্ষা প্রসারের নিমিত্ত মেয়েদের শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত (অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত) অবৈতনিক
করেছেন, স্কুল পর্যায় থেকে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন, মেয়েদের স্বাচ্ছন্দময় বিকাশের লক্ষ্যে দেশে, এখন যতন্ত্র নারী শিক্ষা কেন্দ্রের (গালর্স স্কুল) পাশাপাশি সহশিক্ষা ব্যবস্থা ঢালু করেছেন। এছাড়া বয়স্ক নারীদের শিক্ষার জন্য বয়স্ক নারী শিক্ষা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। বর্তমানে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি মহলও নারী শিক্ষা প্রসারে বিভিন্নভাবে অবদান রেখে যাচ্ছে।
উপর্যুক্ত আলোচনায় দেখা গেল, ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান নারী শিক্ষা বিস্তারে বেশ ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। এই উপবৃত্তির জন্যেও অনেক মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে।
এছাড়া শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য এও এক ধরনের বৃত্তি। এতেও প্রলুব্ধ হয়ে অনেকেই স্কুলগামী হচ্ছে। অবশ্য এটা ছেলেমেয়ে উভয়েই পেয়ে থাকে। তবে, মেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা এবং তাদের জন্য প্রচলিত উপবৃত্তি শুধু মেয়েদের বেলাতেই
প্রযোজ্য। এখন শিক্ষিত হয়ে নারীরা কেমন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তা একটু দেখা যাক।
পূর্বের আলোচনায় দেখা গেছে নারীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বৈমানিক হয়ে আকাশের সীমানা পাড়ি দিচ্ছে। তারা দেশ গঠনেও ও ভূমিকা রাখছে।
একটি সুখি পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু হল নারী, একটি সুখি পরিবার গড়ে তুলতে একজন নারীর ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। শুধু মা হিসেবেই নয়, একজন স্ত্রী হিসেবে একজন নারীর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। একটি পরিবারের সুখ শান্তির চাবিকাঠি থাকে নারীর আঁচলে। তিনি তার জ্ঞান, মেধা ও মনন দিয়ে, তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পারিবারিক জীবনকে সুখে ভরিয়ে তোলেন। “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে“ প্রবাদটি কে না জানে। কিন্তু শিক্ষার অভাব থাকলে সেটা হতে পারে না।
একটা নারী যদি সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে, সত্যিই যদি সে শিক্ষার আলোকে আলোকিত মন ও মনন নিয়ে একটি সংসারে আসেন, কুপমুন্ডকতাকে বিসর্জন দিয়ে আসেন, কেবল তখনই তিনি অন্যের জীবনকেও শান্তিপূর্ণ করে তুলতে পারবেন। এত কিছুর পরও সমাজের অন্তরালে বাল্য বিবাহ,নারী নির্যাতন,যৌন হয়রানি, বুলিংসহ সামাজিক সহিংসতার হার আশানুরুপ হ্রাস পায়নি।
নারীবান্ধব সমাজ বিনির্মান করতে হলে এগুলো হ্রাস করতে হবে। সরকারে একার পক্ষে সবগুলো সমাধান করা সম্ভব নয়। নারীবান্ধব সমাজ বিনির্মানে সচেতন নাগরিক,সুশীল সমাজ ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে এবং এই কাজে সরকারের সদিচ্ছা উদারতা সহযোগীতাই সময়কে এগিয়ে নিয়ে আসতে পারবে।
আমরা আগেই বলেছি দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা হল নারী। সে অর্ধেককে পেছনে ফেলে রেখে গোটা জাতি উন্নত হতে পারে না। তাদেরকে উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত করে জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। জাতিকে শিক্ষার আলোকে উল্লসিত করতে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। নারীবান্ধব শিক্ষাবিস্তার ও উন্নয়নে উপবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক চর্চাসহ নানামূখী সৃজনশীল
কর্মসূেিত যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করে একযোগে মার্চ করে এগিয়ে যেতে পারলে টেকসই নারী উন্নয়ন সম্ভব।
[লেখক: মো. নজরুল ইসলাম, উন্নয়নকর্মী ও গবেষক, প্রকল্প কর্মকর্তা,বারসিক]