
দশম শতাব্দীর ইরাকের মহান কবি আবু তাইয়িব আল মুতানাব্বি একসময় সিরিয়ার আলেপ্পো রাজ্যে বাস করেছিলেন। হায়রে দুর্ভাগা আলেপ্পো! এমনকি, তিনি সিরিয়ায় একটি বিদ্রোহে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। আর এটা জানা আছে, অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সাথে সে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল। আল মুতানাব্বিকে তখন দুই বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছে। সিরিয়াতে বেশির ভাগ আরব শিশুই মুতানাব্বির কবিতায় উদ্ধৃতি দিতে পারে। তাদের এমন একটি প্রিয় কবিতার প্রথম দু’লাইন হলো- ‘যখন দেখতে পাও সিংহের দাঁত;/ভেবো না, সে হাসছে তোমাকে দেখে।’
এবার দামেস্কের শহরতলি বারজেহ এলাকায় বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেন্দ্র্রের পাশে ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে কষ্ট করে এগিয়ে যাওয়ার সময় ওই সিংহের কথা আমার মনে পড়ে গেল। এই সেই কেন্দ্র যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিসাইলের আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। মিসাইগুলো আঘাত হানছিল ‘সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচির হৃৎপিণ্ডে। উপগ্রহ থেকে তোলা বিভিন্ন ছবির সুবাদে এই কেন্দ্র এখন সুপরিচিত। কিন্তু আসলেই কি রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচিকে আঘাত করা হয়েছে?
‘ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যান্ড সিভিলিয়ান কেমিক্যাল রিসার্চ’ ডিপার্টমেন্টের এই অঙ্গনে অন্তত ১৩টি মিসাইল হানা দিয়েছে। এখানে কী কী কাজ করা হয়, তা নিবিড়ভাবে জানা দরকার। সিরিয়ার এই প্রতিষ্ঠানে যেতে আমাকে বাধা দেয়া হলো তিন দিন ধরে। যদি সেখানে সবকিছুু বিধ্বস্তই হয়ে থাকে (আসলেই সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং ছবিতে যতটা মনে হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে), তাহলে কেন বাধা দেয়া হলো?
এর কী তাৎপর্য আছে? হ্যাঁ, আছে বৈকি। আমাকে মনে করিয়ে দেয়া হলো, ১৯৯১ সালে ইরাকের ‘বেবি মিল্ক ফ্যাক্টরি’তে আমেরিকা বোমা ফেলেছিল। অথচ জেনারেল কলিন পাওয়েল তখন বলেছিলেন, ‘এটা জীবাণু অস্ত্রের কারখানা; আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত।’ আমার সহকর্মী প্যাট্রিক ককবার্ন গত সপ্তাহে এ বিষয়ে লিখেছে। ককবার্ন জানিয়েছে, সে বোমাবর্ষণের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই ওই ফ্যাক্টরিটি পরিদর্শন করেছিল। সে যুদ্ধের পর জানা গেল, ‘ওই ভবনে সম্ভবত শিশুখাদ্য তৈরি করা হতো।’ যেন শিশুদের এক গ্লাস দুধ দিয়েও কী না করা যায়!
আমরা বিশ্বাস করি, সব আরব একনায়ক নিয়মিত মিথ্যা বলেন। আমরা যারা পাশ্চাত্যের লোক, তারা নিজেদের নেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে থাকি। এই নেতারা যখন আমাদের জন্য কাজ করেন, তখন তারা যাতে সত্য বলেন, তা নিশ্চিত করা হয়। এ কারণে, সিরিয়ার দুমাতে এবার যে হামলা করা হলো, এর ব্যাখ্যা দেয়া দরকার। এ কারণেই জানতে চেয়েছি, দুমা হামলার সারাসরি জবাব হিসেবে বারজেহতে ধ্বংকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, সে ব্যাপারে যা বলা হলো, তা কি সত্যি? নাকি সিরিয়ার লোকজন এটাকে চিকিৎসা গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে যে দাবি করছে, সেটাই সঠিক? ‘সিংহ’ কি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছিল? নাকি আমি সিংহের চেহারা দেখে এর ভুল অর্থ করেছি?
সিরিয়ার উল্লিখিত গবেষণাকেন্দ্রের পলিমার বিভাগের প্রধান ডা: সাঈদ আল সাঈদ হাসছিলেন। তার সাথে যখন দেখা হয়েছে, দেখলাম সেখানে কোনো প্রহরী নেই। মার্কিন হামলাকারীদের দাবি, এটা রাসায়নিক যুদ্ধসংক্রান্ত গবেষণাকেন্দ্র। কিন্তু এটা দেখে এর কোনো প্রমাণ পাইনি বলা চলে। ১৯২টি রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত, রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করার সংগঠন ‘ওপিসিডব্লিউ’ সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে এটি পরিদর্শন করে বলেছে, ‘সেখানে কোনো রাসায়নিক কিংবা জীবাণু অস্ত্র আরো শক্তিশালী, পরীক্ষা বা উৎপাদন করার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’ একই সংগঠন সম্প্রতি দুমায় সম্ভাব্য গ্যাস হামলার বিষয়ে তদন্ত করে দেখছে।
যা হোক, ডা: সাঈদ আল সাঈদ বললেন, এটা যদি রাসায়নিক অস্ত্রের কারখানা হতো, আজ এখানে আপনি দাঁড়ানোর সাথে সাথেই মারা যেতেন। হতে পারে, এখানে কেবল গবেষণাই হতো; তবে রাসায়নিক অস্ত্র মজুদ করে রাখা হতো না (যেমনটি আমেরিকা দাবি করেছে)।
এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ধ্বংসস্তূপটি মাড়িয়ে গেলাম। দেখলাম, এই গবেষণা ক্যাম্পাসের পাঁচটি ভবন উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রোদের মধ্যে ইচ্ছামতো সেখানে ঘোরাফেরা করেছি। এটা দেখে ৬৪ বছর বয়সী ডা: সাঈদ মজা পেলেন। এর চার দিন আগে ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি বিমান হামলা হয়েছে সেখানে। পশ্চিমা জগতের রাজনীতিকেরা সর্বদা তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে থাকেন, ‘বোমা ফেলার জায়গাগুলো সাংবাদিকদের দেখতে দেয়ার আগে ওরা নিজেদের সংশ্লিষ্টতার সব প্রমাণ মুছে সাফ করে দেয়।’ বারজেহ এলাকার গবেষণাকেন্দ্রটি দেখার জন্য তিন দিন আমাকে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। তবে এরপর যখন গাড়ি চালিয়ে গেট দিয়ে এই ক্যাম্পাসে ঢুকলাম, বিভিন্ন ফাইল ও নথিপত্র ধ্বংসস্তূপের মাঝে চোখে পড়ছিল। সেগুলো মৃদু হাওয়ায় নড়ছিল। সেখানে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক যে কাগজপত্র আমি পেয়েছি, তা ছিল সিরিয়ার গ্রামাঞ্চলে লবণাক্ততা দূরীকরণ প্রকল্প সংক্রান্ত। আরো পেয়েছি কুয়েতি বিজ্ঞানীদের ইংরেজিতে লেখা দীর্ঘ রিপোর্ট, যা ছিল কঙক্রিটের তৈরি ব্রিজের ছিদ্র বন্ধ করতে রাবার ব্যবহার সংক্রান্ত। আমি যখন সেখানে অবস্থান করছিলাম, যন্ত্র দিয়ে খননকারীরা ধ্বংসস্তূপের ইটপাথর, কঙক্রিট ইত্যাদি তুলে ট্রাকে ভরছিলেন ফেলে দেয়ার জন্য। সে ধ্বংসস্তূপেও কিছু কাগজপত্র দেখা যাচ্ছিল। রাখঢাক করা হলে কি এমন দৃশ্য দেখা যেতে পারে?
সিরিয়া সরকার কি চার দিনে সরিয়ে ফেলতে পারে তার নিজের দায়ের দলিলপত্র? আমি নিজে রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ নই। তবে অবশ্যই ওপিসিডব্লিউ এ ব্যাপারে গভীর জ্ঞান রাখে। তারা ২০১৩ সালে বারজেহ পরিদর্শন করেছে কয়েক দফা। এরপর কী ঘটেছে? ডা: আল সাঈদ আমাকে বললেন, ওপিসিডব্লিউ জানিয়েছিল, ‘এখানে রাসায়নিক যুদ্ধ নিয়ে গবেষণার কোনো প্রমাণ মিলেনি।’ প্রকাশিত রিপোর্টগুলোতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। অবশ্য গত নভেম্বর মাসের পর কেউ বারজেহ পরিদর্শন করেননি। তবে যে প্রশ্ন না জেগে পারে না, তা হলো- গত পাঁচ মাসে যদি বারজেহতে অবস্থিত কেন্দ্রটির উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ হতো, তা হলে কি ওপিসিডব্লিউ তা উল্লেখ করত না? যা হোক, দেখলাম-ধ্বংসস্তূপ থেকে প্লাস্টিক পোড়ার কটু গন্ধ বের হচ্ছিল। ডা: সাঈদ জানান, ‘এটা পুড়ে যাওয়া কম্পিউটার আর প্লাস্টিক নির্মিত ডেস্কের গন্ধ।’
ধ্বংসস্তূপের একেবারে ভেতরের দিকে হেঁটে গেলাম। তবে এতে সেখানে নিয়োজিত কর্মীরা কিংবা মোটাসোটা কর্তাব্যক্তি নার্ভাস হননি। কেউ আমাকে থামিয়েও দেননি। মানুষ নার্ভাস হয়ে গেলে এমনটা করে থাকে। এটা ঘটেছিল আমার সার্বিয়া সফরের সময়। ন্যাটো বাহিনী সেখানে একটি হাসপাতালে বোমা বর্ষণ করেছিল। এর পেছনে সেনাবাহিনীর কয়েকটি পরিখা দেখতে পেয়েছিলাম। তখনই আমাকে বাধা দেয়া হয়। কারণ বুঝা যাচ্ছিল, হাসপাতালে বোমা ফেলায় নিরীহ রোগীরা মারা পড়লেন। কিন্তু সেখানে লুকানো যুগোশ্লাভ সেনারা ছিল অক্ষত। এটা ছিল অন্যায়। সিরিয়ার বারজেহ প্রসঙ্গে বলছিলাম। সেখানে যে বিল্ডিংগুলো অক্ষত ছিল, সেগুলো শিক্ষার্থীদের লেকচার রুম। শিশুদের একটি স্কুলও ছিল সেখানে। এর দেয়ালে অনেক আগে আঁকা ছবি বিবর্ণ হয়ে এসেছিল।
ডা: সাঈদ নিজে ব্যবহারিক রসায়নবিদ হিসেবে ট্রেনিং নিয়েছেন। পূর্ব জার্মানির আমলে সেখানকার ড্রেসডেনে প্রথম এবং ডুসেলডর্ফে এরপর এই ট্রেনিং নিয়েছিলেন। বারজেহর কেন্দ্রটিতে তিনি ১৫ বছর ধরে কাজ করে আসছেন। তবে এবার ভোরবেলায় যখন এখানে মিসাইল হামলা ঘটে, তখন তিনি ১০ মাইল দূরের বাড়িতে ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি এর টার্গেট হওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন কি?’ তার জবাব- ‘আমি তো রাজনীতির বিশেষজ্ঞ নই। তবে আপনি মনে করতে পারেন- আমেরিকান, ব্রিটিশ আর ফরাসিরা যেকোনো কিছু ঘটাতে পারে।’
সাঈদ জোর দিয়ে বললেন, ‘এখানে আমার ছাত্র আর লেকচারাররা গবেষণা করছিলেন ওষুধ হিসেবে রাসায়নিকের ব্যবহার, বিশেষ করে বিচ্ছু ও সাপের ডিএনএ এবং ক্যান্সার ও লিউকেমিয়া রোগের বিষয়ে। আমরা যে ওষুধের ব্যাপারে গবেষণা করছিলাম, তা দেশের মধ্যে ব্যবহারের জন্য। তবে মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র এটা বিক্রি হয়ে থাকে। তেলশিল্পের জন্য রাবার কণা তৈরি এবং ব্রিজ নির্মাণে রাবার ব্যবহার নিয়ে গবেষণার কাজ করছিলাম আমরা।’ তিনি যখন আমাকে এসব কথা বলছিলেন, তখন জানতেন না যে, ধ্বংসস্তূপের ভেতরে ইতোমধ্যেই আমি তার উল্লিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কিত কাগজপত্র পেয়ে গেছি। এটা তার বক্তব্যের সত্যতার একটি প্রমাণ। তিনি জানালেন, ‘ওপিসিডব্লিউ আমাদের দু-দু’বার সনদ দিয়েছে।’
লক্ষ করলাম, ১৮ মাস আগে যেখানে ‘নুসরাহ’ এবং ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ বিদ্রোহীদের তুমুল লড়াই বেধেছিল সরকারি বাহিনীর সাথে, সেখান থেকে এক মাইলেরও কম দূরত্বে বারজেহর এই বৃহৎ গবেষণা ক্যাম্পাস অবস্থিত। নিজে ওই যুদ্ধ কিছুটা দেখেছি। সিরিয়ার সরকার কি এমন জায়গায় রাসায়নিক অস্ত্র গবেষণাকেন্দ্র রেখে দিয়েছিল, যা যেকোনো সময়ে দুশমনের করায়ত্ত হতে পারে? আমেরিকা বলেছে, বারজেহর কেন্দ্রটিতে রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্রের গবেষণা, সমৃদ্ধকরণ, উৎপাদন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতো। যদি এ অভিযোগ সত্য হয়, তাহলে বলা যায়- সিরীয় সরকার মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছিল যুদ্ধের আগে-পরে। আমেরিকানদের এ কথা সঠিক হলে ধারণা করা যেতে পারে, ওপিসিডব্লিউ পরিদর্শকরা শেষবারের মতো বারজেহ কেন্দ্র পরিদর্শনের পর গত পাঁচ মাসে সেখানে পরিবর্তন আনার জন্য বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে হয়েছে।
বাগদাদে ‘জীবাণু অস্ত্রের কারখানা’ বলে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বোমা ফেলেছিল, সেটা আসলে ছিল শিশুদের জন্য দুধ তৈরি করার কারখানা- এ ধারণাই এখন সবাই সঠিক বলে মনে করছেন। এদিকে, আজ সিরিয়ার বারজেহ গবেষণা কমপ্লেক্সের ধ্বংসস্তূপের পাশে বাশার আল আসাদের বিরাট প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে। এর ওপর আরবিতে লেখা ‘আপনাদের জন্যই সবকিছু’। যাক, সেই অতীতের কবিতায় উল্লিখিত সিংহের কথায় ফিরে যাই। কবি মুতানাব্বি কবিতার মাধ্যমে এক ব্যক্তিকে অপমান করেছিলেন। সে লোক কবিকে এ জন্য হত্যা করেছিল। তার নাম দাব্বাহ আল আসাদি। অবশ্য বাশার আল আসাদের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
লেখাটি প্রথমে ব্রিটেনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেট পত্রিকায় প্রকাশিত, যে পত্রিকার সাথে এই বিখ্যাত কলামিস্ট দীর্ঘ দিন জড়িত।
ভাষান্তর করেছেন মীযানুল করীম
রবার্ট ফিস্ক/নয়া দিগন্ত