sliderমহানগরশিরোনাম

ঢাকায় প্রথম পাবলিক বাস সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা মোমিন মটর কোম্পানির অজানা ইতিহাস-২য় পর্ব

ঐতিহাসিক পুরান ঢাকার কিংবদন্তি গর্বিত সন্তান

ইসলাম উদ্দিন বাবুল : ঢাকা শহরে প্রথম পাবলিক বাস সার্ভিস “মুড়ির টিন” মটরগাড়ির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আব্দুল আজিজ (মোমিন মটর কোম্পানি) এর অজানা কিছু ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ঢাকায় অবস্থানরত ব্রিটিশ ইংরেজেরা যুদ্ধ্যে ব্যাবহার করা সৈন্যবাহি ট্রাক লরী বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে বেশ কিছু ট্রাক মোমিন কোম্পানি স্বল্পদামে কিনে নেয়। এরপর সেইসব ট্রাকের চ্যাসিসের উপর টিন ও কাঠদিয়ে বডি তৈরি করে যাত্রী পরিবহনের উপযোগি একদরজা বিশিষ্ট বাস নির্মান করেন। তখনকার নির্মিত বাস গুলিতে এখনকার মত আধুনিক সুযোগ সুবিধা ছিলো না। বাসের ভিতরে যাত্রি পরিবহনের সিটগুলি কাঠের তৈরি ছিলো। ড্রাইভার বাসের সামনে একটি ঘেরাও করা চেম্বারে চালকের আসনে বসে বাস চালাইতেন। ড্রাইভারের কেবিনের পেছনে মহিলাদের আলাদা কেবিনে বসার ব্যাবস্থা ছিলো। তখন বাস ষ্টার্ট করার এখনকার মত কোন সেল্ফ ষ্টাটারের ব্যাবস্থা ছিলোনা। লোহার দন্ড দিয়ে নির্মীত হ্যান্ডেল যাহা (দ) আকারে ছিলো৷ এই হ্যান্ডেল গাড়ির সামনের অংশের একটি ছিদ্রের ভিতর ঢুকিয়ে ইঞ্জিনের অংশে লাগিয়ে জোরেজোরে ঘুড়িয়ে বাস ষ্টার্ট করা হইতো। তখন এখনকার মত হাইড্রলিক হর্ন ছিলো না। রবার দিয়ে বানানো বেলুন আকৃতির হর্ন বা ভেপু হাতদিয়ে টিপে বাজানো হইতো। গাড়ির ভিতরে পেছন থেকে লম্বা দড়ি দিয়ে বাধা একটি ঘন্টা সামনের অংশে ড্রাইভারের পাশে লাগানো থাকতো। কোন ষ্টপেজে গাড়ি থামানোর প্রয়োজন হইলে বাস কন্ট্রাক্টর সেই দড়িটেনে ঘন্টা বাজিয়ে ড্রাইভারকে সংকেত দিতো। বাসের ভিতর কন্ট্রাকটর চামড়া দিয়ে বানানো ব্যাগ গলায় ঝুলিয়ে ভাড়া আদায় করতো। যাত্রিরা তখন আনা,পয়সা দিয়ে ভাড়া পরিশোধ করতো। পুরান ঢাকার রসিক মানুষেরা তখন “মুড়িরটিন” নামে এই গাড়ির নাম করন করেন। তখন থেকে অদ্যবধি এই গাড়ির নাম “মুড়ির টিন” নামেই ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছে।

মোমিন কোম্পানির লালবাগের বাসার কাছেই ঢাকার প্রধান ব্যাবসাকেন্দ্র চকবাজার হওয়ায় তিনি প্রথমে চকবাজার টু সদরঘাটের রাস্তায় এইবাস চলাচল শুরু করেন। চকবাজার তখন এখনকার মত এত ঘিঞ্জি ছিলো না। এইজন্য তিনি চকবাজারের জেলখানার ওয়াল ঘেষে একটি বাসষ্যান্ড নির্মান করেছিলেন। (বাসষ্ট্যান্ডটি ছবিতে দেয়া আছে)। তার বাসার কাছেই ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশেই তার নিজস্ব জায়গার মুড়ির টিন বাসের ওয়ার্কশপ নির্মান করেছিলেন। ছোটবেলায় আমি এখানে অনেক গাড়ি মেরামত করতে দেখেছি। একসময় লালবাগ কেল্লার চৌরাস্তার পশ্চিমে ৮নং গলির কাছের বাড়ির মরহুম গফুর মিস্ত্রি এই ওয়ার্কশপের হেডমিস্ত্রি/ মেকানিক ছিলেন। আমার বাড়ির পাশেই তার বাসা থাকায় উনার পরিবারের সদস্যদের সাথে আমার এখনো যোগাযোগ আছে। সম্পর্কে তিনি মোমিন কোম্পানির আপন শালির জামাই ছিলেন। মুড়ির টিন বাসের একটি গ্যারেজ লালবাগের বর্তমান রহমতুল্লাহ মহিলা স্কুলের সাথে একটি বড় মাঠ ছিল যা রাজা শ্রীনাথের জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গা ছিল সেখানেই কিছু বাস রাখতেন। আমি ছোট বেলায় এই মুড়ির টিন গাড়ি গুলোকে কেল্লার মোড় হয়ে বুড়িগংগা নদীর অপর পারে জিঞ্জিরায় যেতে দেখেছি। সেই সময় দুইটি বড় নৌকার মাঝে পাটাতন বিছিয়ে তার মাঝে বাস উঠিয়ে নদী পারাপার করে জিঞ্জিরা বাজার ঘাটে নেয়া হইতো। (সেই আমলের কাঠের ফেরির একটি ছবি দেয়া আছে)।

জিঞ্জিরা তখন একটা সবুজেঘেরা গ্রাম্য পরিবেশে একটা নদী বন্দর ছিলো। এখানে তখন বিরাট পাইকারি এবং খুচরা আড়ত ও দোকানে ভরপুর ছিলো। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহ নির্মান সামগ্রী সব কিছুই তখন জিঞ্জিরা থেকে কিনতে হইতো। পাকিস্তান আমলে ছোট বেলায় আমার বাবার সাথে সোয়ারিঘাট থেকে নৌকায় চড়ে নদীর পাড়ে জিঞ্জিরায় বাজার করতে যাইতাম। জিঞ্জিরার নিকটবর্তি এলাকা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী সৈয়দপুর, মরিচা, কলাকোপা, আগলা, গালিমপুর, কোমরগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, বক্সনগরের প্রচুর মানুষ প্রত্যেকদিন হাটবাজার বা ঢাকায় আসা যাওয়ার জন্য জিঞ্জিরাকে ব্যাবহার করতো। সে সময় এই সব অঞ্চলে যাতায়াতের কোন ব্যাবস্থা না থাকায় সাধারন মানুষকে অনেক কষ্ট, দুর্দশা পোহাইতে হইতো যা ভাষায় প্রকাশ যায়না। একসময় মোমিন কোম্পানি এই সব অঞ্চলের সাধারন মানুষের দু;খ্য, দুর্দশা, কষ্ট লাঘবের জন্য তাদের সুবিধার্থে কঠিন পদক্ষেপ নিলেন যাহা তখনকার সরকারের পক্ষেও করা সম্ভব ছিলো না। তিনি তৎকালীন ডিষ্ট্রিকবোর্ড থেকে সরকারি কিছুজায়গা ল্যিজ নিলেন। অনেক জায়গা স্থানীয় গ্রামের মানুষেরা রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট বানানোর জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। একসময় মোমিন কোম্পানি নিজের টাকায় রাস্তা নির্মান করে সেই সব অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যাবস্থার আমুল পরিবর্তন করেন এবং পাবলিক বাস সার্ভিস চলাচল শুরু করান।

তিনি শুধু রাস্তা নির্মান করেন নাই। এইসব অঞ্চলের রাস্তার পাশে যাত্রী এবং স্থানিয়দের নামাজ পড়ার জন্য অনেক মসজিদ নির্মান করাইয়াছিলেন। এছাড়াও তিনি অনেক গ্রামে মাদ্রাসা, এতিমখানা নির্মান করেছিলেন। যার অনেকটা আমি দেখিয়াছি। মুড়ির টিনের আমলে আমি জিঞ্জিরা থেকে বাসে চড়ে মরিচা লঞ্চ/ফেরি পার হয়ে আগলা গালিমপুরে যাইতাম। এইজন্য সে সময় এইসব দেখার আমার সৌভাগ্য হইয়াছে। একটা বিষয় এখনো মনেআছে, সে সময় এই বাসে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশের গাছের ডালপালার বারি খেয়ে খেয়ে বাস চলতো। অনেক জায়গায় গাছের ডালপাতার আঘাত থেকে বাচার জন্য আমরা জানালা বন্ধ করে দিতাম। রাস্তাগুলো খুবই সরু এবং ইটের সোলিং করা ছিলো। রাস্তা গুলো একটি গাড়ি চলাচলের উপযোগি করে বানানো ছিলো৷ যদি কোন স্থানে দুইটি গাড়ি মুখোমুখি হইলে একটি গাড়ীর ড্রাইভার দুর থেকেই তার গাড়িকে গ্রামের কাচা রাস্তায় বা ঝোপ জংগলে ঢুকিয়ে অপর গাড়িকে যাওয়ার ব্যাবস্থা করতো। সন্ধ্যার পরে গাড়ি আর চলাচল করতোনা। আমি জিঞ্জিরা থেকে মুড়িরটিন বাসে চড়ে নবাবগঞ্জের আগলা বাজারে নেমে আন্ধার কোঠা গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আংগুর ভায়ের বাসায় যেতাম। (চলবে) অংশে

লেখক- ইসলাম উদ্দিন বাবুল -পুরান ঢাকার লেখক,
সিনিয়র এডমিন – পুরান ঢাকার লেখক ও গবেষক ফোরাম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Back to top button