sliderমতামতশিরোনাম

ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস: নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের আলোকবর্তিকা

আমির হোসেন সজিব : বাংলাদেশের ইতিহাসে নানা সময় নানা সংকট এসেছে। রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাহিনি আজ সর্বজনবিদিত। গত এক দশকে বাংলাদেশ এক ফ্যাসিস্ট শাসনের অধীনে গণতন্ত্রহীন এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক সুবিচার চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন শাসনামলে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ এবং সর্বোপরি দুর্নীতির অভ্যুত্থান দেশকে একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
এই সংকটে, ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস-এর মতো একজন পরীক্ষিত, স্বচ্ছ এবং মানবিক নেতৃত্ব প্রয়োজন, যিনি ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছেন দারিদ্র্য বিমোচনের মডেল হিসেবে।

ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস: সংক্ষিপ্ত পরিচয়:

ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪০ সালের ২৮ জুন, চট্টগ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ালেখা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় যান এবং Vanderbilt University থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
তবে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়। তিনি দেখলেন একেকজন মানুষ অতি সামান্য ঋণের অভাবে কীভাবে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এখান থেকেই তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ধারণা নিয়ে আসেন।
গ্রামীণ ব্যাংক: দারিদ্র্য বিমোচনের রূপকথা
১৯৭৬ সালে, একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল – দরিদ্র মানুষকে জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো।
এই মডেল এতটাই কার্যকর ছিল যে, পরবর্তীতে তা বিশ্বের বহু দেশে অনুকরণ করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল:
নারী ক্ষমতায়ন: গ্রামীণ ব্যাংকের অধিকাংশ ঋণ গ্রহীতা ছিলেন নারী, যা নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিল।
আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি: মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়, তারা ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারে।
সামাজিক প্রভাব: দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় ইতিবাচক পরিবর্তন।

এই উদ্ভাবনের জন্য ডঃ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন: এক পর্যালোচনাঃ
২০০৯ সালের পর থেকে শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ কার্যত একদলীয় শাসনে পরিণত হয়েছে।
মূল সমস্যা গুলো ছিল:
গণতন্ত্রহীনতা: নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ও অংশগ্রহণহীন।
বিচার বিভাগের দলীয়করণ: আদালত রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করতে ব্যবহৃত হয়েছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন: গুম, খুন, সাংবাদিক নির্যাতন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার ইত্যাদি।
অর্থনৈতিক দুর্নীতি: ব্যাংকিং খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
স্বাধীন মিডিয়ার নিধন: সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
এই ধরনের শাসনের ফলে দেশের অর্থনৈতিক ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে পড়ে, এবং সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে।

ফ্যাসিস্ট পতনের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতাঃ
যখন একজন ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন ঘটে, তখন শুধু রাজনৈতিক শূন্যতা নয়, বরং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও দেখা দেয়। দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য দরকার হয় স্বচ্ছতা, বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব, এবং বিকল্প অর্থনৈতিক দর্শন।
এই পরিস্থিতিতে ডঃ ইউনুস হতে পারেন সবচেয়ে কার্যকর নেতৃত্ব:
তিনি দলনিরপেক্ষ।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে।
জনগণের আস্থা আছে তাঁর প্রতি।
তিনি দেশকে তৃণমূল পর্যায় থেকে গড়ার রূপরেখা দিতে পারেন।
ডঃ ইউনূস-এর অর্থনৈতিক দর্শনঃ
ডঃ ইউনূস বিশ্বাস করেন “Social Business”–এ, অর্থাৎ এমন ব্যবসা যা শুধু লাভের জন্য নয়, বরং সমাজের সমস্যার সমাধানে নিয়োজিত। তার মতে, দারিদ্র্য শুধু অর্থের অভাব নয়; এটি সুযোগের অভাব।
Social Business-এর বৈশিষ্ট্য:
মুনাফা নয়, প্রভাবই লক্ষ্য।
আত্মনির্ভরতা বাড়ায়।
যুবসমাজকে উদ্যোক্তা হতে অনুপ্রাণিত করে।
রাষ্ট্রীয় সাহায্য ছাড়াই চলতে পারে।
এই দর্শনই হতে পারে বাংলাদেশের নতুন অর্থনীতির ভিত্তি।
যুবসমাজের শক্তিকে কাজে লাগানোর রূপরেখাঃ
বাংলাদেশের ৬৫% জনগণ যুবক। তারা বেকার, হতাশ এবং উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে অপ্রস্তুত। ডঃ ইউনূস এই যুবকদের জন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারেন।
সম্ভাব্য উদ্যোগ:
উদ্যোক্তা তৈরি কার্যক্রম.
Social Business Training Institute
Micro Venture Fund for Startups
ডিজিটাল শিক্ষায় বিনিয়োগ
স্থানীয়ভাবে কৃষি ও হস্তশিল্পে নব্য প্রযুক্তি প্রয়োগ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিনিয়োগ আনার সম্ভাবনাঃ
ডঃ ইউনূস-এর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাংলাদেশকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলবে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত রাষ্ট্র তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশে সহযোগিতা করতে আগ্রহী হবে।
বিশেষভাবে, তিনি যেসব সুবিধা এনে দিতে পারেন:
বিশ্বব্যাংক ও IMF-এর আস্থা ফেরানো
উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠন
টেকসই উন্নয়নে সহায়তা
মাইগ্রেশন ও রেমিটেন্স সেক্টরে নতুন উদ্যোগ
সমালোচনার জবাবঃ
বেশ কিছু রাজনৈতিক শক্তি ডঃ ইউনূসকে হেয় করার চেষ্টা করেছিল , বিশেষ করে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো – তাঁর বিরুদ্ধে কী কোনো দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে?
না। বরং, তাঁকে প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে।
তাঁর নেতৃত্বাধীন গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার অপচেষ্টা হয়েছিল।
তাঁর নোবেল জয়কে পর্যন্ত অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা হয়েছে।
তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে – যারা মানুষের জন্য কাজ করে, তাদের শেষ পর্যন্ত মানুষই সমর্থন দেয়।

পরিশেষে;একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নঃ
বাংলাদেশ এমন এক সময় পার করছে, যখন প্রয়োজন তৃণমূল অর্থনীতির জাগরণ, যুবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং মানবিক নেতৃত্ব।
এই মুহূর্তে ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস-এর মতো একজন বিশ্বমানের নেতা হতে পারেন জাতির আলোকবর্তিকা। তিনি শুধু একজন অর্থনীতিবিদ নন, তিনি একজন দার্শনিক, একজন মানবিক নেতা, একজন সমাজনির্মাতা।
ফ্যাসিস্ট শাসনের ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য ডঃ ইউনূস হতে পারেন সেই বিশ্বাসের প্রতীক, যিনি সমাজের প্রান্তিক থেকে শুরু করে জাতীয় অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিবর্তনের বাতাস বইয়ে দিতে পারেন।
“আমরা এমন একটি বিশ্ব গড়তে চাই, যেখানে ইতিহাসে দারিদ্র্য থাকবে শুধু মিউজিয়ামে।” — ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button