sliderস্থানীয়

ঠাকুরগাঁওয়ে চা বিক্রেতা এরফানের বিরুদ্ধে বিদ্যালয় গায়েব করার অভিযোগ

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ চা বিক্রেতা থেকে প্রধান মন্ত্রী হওয়া নরেন্দ্র মোদীর কথা আমাদের সবারই জানা। কিন্তু শিক্ষকতা চাকরির লোভে একজন চা বিক্রেতা সুকৌশলে একটি বিদ্যালয় এক স্থান থেকে গায়েব করে অন্য স্থানে স্থাপন করে সে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হয়েছে এমন ঘটনা বিরল।

এমন বিরল ঘটনার সন্ধান মিলবে ২০২৩ সালে মোট ১৭টি ক্যাটাগরিতে দেশ সেরা বিদ্যালয় ও প্রধান শিক্ষকের পুরস্কার প্রাপ্ত ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের প্রধান শিক্ষক হয়ে উঠার নেপথ্যের ঘটনা থেকে ।

বিদ্যালয়টি স্থাপনার সরকার অনুমোদিত জমি থেকে গায়েব করে দিয়ে নিজ জমিতে স্থাপন করার পর একটি মনগড়া ম্যানিজিং কমিটি গঠন করে প্রভাব খাটিয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নেন চা বিক্রেতা এরফান আলী। তিনি একা নন, বিদ্যালয়ের সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব ও ভয় দেখিয়ে একই বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পদে চাকরি দিয়েছেন নিজের স্ত্রী সুরাইয়া পারভীন ও দুই বোন রেহেনা খাতুন এবং মিতালি পারভিনকে। সেই থেকে একই পরিবারের চারজন শিক্ষক দিয়ে পরিচালনা হয়ে আসছে বিদ্যালয়টি।
এমন অভিযোগ তুলে ধরে তদন্তের দাবি করেন স্থানীয় গ্রামবাসী ও গ্রামের ওই স্কুলের সাবেক একাধিক বঞ্চিত শিক্ষক ও শিক্ষকের চাকরি প্রত্যাশি একাধিক যুবক এবং বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি খলিলুর রহমান ।

চাকরি প্রত্যাশী যুবক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ২০১৪ সালে এরফান আলী যখন বিদ্যালয়টি আগের জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে তার নিজ জমিতে নিয়ে আসেন তখন আমাকে তাদের সঙ্গে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব দেন এবং আমার থেকে ৭ লাখ টাকা নেন। তারপরেও চাকরি দেননি। ২০১৪ সালের আগে এরফান আলী কোথাও শিক্ষকতা করেননি । তিনি যে ২০০৮ সালে তার চাকরিতে যোগদান দেখাচ্ছেন এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ২০১৪ সালের আগে তার কোন স্কুল ছিলোনা।

গ্রামবাসী জানান, তৎকালীন সরকার কর্তৃক প্রত্যেক ওয়ার্ডে দুইটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার ঘোষণা আসে। সে সময় এ ওয়ার্ডে সিংহাড়ী নামে একটিমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। গ্রামের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে ২০০০-২০০১ সালের দিকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামবাসী। এর জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হলে কিভাবে বিদ্যালয় চালু করতে হবে সে নিয়ম জানিয়ে চিঠি দেয়া হয় আবেদনকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সব নিয়মকানুন মেনে বিদ্যালয়ের জন্য ৩৩ শতক জমি রেজিষ্ট্রি করে দেন গ্রামের দুই ব্যক্তি আ: রহমান ও কদম আলী। এই জমিতে টিনের বেড়া দিয়ে স্থাপন করা হয় চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গ্রামের লোকজন এক সভা আহ্বান করে গ্রামের বাসিন্দা খলিলুর রহমানকে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি করে বিদ্যালয় ম্যানিজিং কমিটি গঠন করা হয়।

চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, সে সময়কালে আমাকে সভাপতি করে একটি ম্যানিজিং কমিটি গঠন করা হয় এবং ওই বছরে একটি দৈনিকি পত্রিকায় একজন প্রধান শিক্ষক সহ তিনজন সহকারি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। নিয়োগ পক্রিয়া সম্পন্ন হলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আলতাফুর রহমান সহ আরও তিনজন সহকারি শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। তার দাবি সে সময় নিয়মিত উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের একাধিক কর্মকর্তা বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে গেছেন।

২০১১ সালের ৮ মে, রংপুর বিভাগীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের এক কাগজ প্রতিবেদকের হাতে আসে। সে কাগজে সিংহাড়ী মৌজার ১৯৯০ ও ১৯৯১ দাগে ৩৩ শতক জমিতে নির্মিত চরভিটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের প্রাথমিক অনুমোদন দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ২০১১ সালে যেসব দাগ উল্লেখ করে চরভিটা বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছিলো রংপুর বিভাগের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর সে জমিতে বিদ্যালয় কোন চিহ্নই নেই। চাষাবাদ হচ্ছে ধানের । এলাকাবাসী বলছে এটিই সেই জমি যার মালিক এখনো সরকারই ।

তাহলে এরফান আলী যে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছে সেটি কোনটি? নাকি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে পূর্বের জমির অনুমোদনের কাগজ দিয়ে তার জমিতে বিদ্যালয় পরিচালনা হয়ে আসছে? তার জমিতে বিদ্যালয় বৈধ কি না জানতে চান এলাকাবাসী?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রবীণ গ্রামবাসী জানান, চা বিক্রেতা এরফান আলীর শিক্ষকতা করার ইচ্ছা থাকলেও তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিলোনা ৷ গ্রামে ২০০০-২০০১ সালের দিকে বিদ্যালয় হওয়াতে তার এ লোভ অতিলোভে পরিণত হয়েছিলো। সে যেন এখানে অসৎ উপায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারে এরজন্য নকল শিক্ষাগত সনদসহ নানা কৌশল অবলম্বন করে ৷ যখন কোনভাবে পেরে উঠেনা তখন নিজে থেকে নানা নাটকীয়তার জন্ম দেয় এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গ্রামবাসী অনেকের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রামছাড়া করার পায়তারা করে। এরপর ২০১৩ সালে দেশের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহ জাতীয়করণ হলে শিক্ষক হওয়ার লোভ মাথাচারা দেয় এরফান আলীর। ২০১৪ সালে আওয়ামীলীগের দু:শাসন আমলের মুখ্যম সময়ে সরকার দলীয় নেতাদের মদদে সরকার অনুমোদিত জমিতে অস্থায়ী বিদ্যালয় ঘর খুলে দিনেদুপুরে গায়েব করে দেন এবং পরবর্তীতে নিজের জমিতে বিদ্যালয়টি স্থাপন করেন এবং প্রভাব খাটিয়ে প্রধান শিক্ষক হয়ে যান।

এ ঘটনায় ঠাকুরগাঁও আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন বিদ্যালয়ের তৎকালীন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আলতাফুর রহমান।

এ বিষয়ে জানতে পূর্ব অনুমতি নিয়ে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলীর দেয়া নির্ধারিত দিনে তার বিদ্যালয়ে কাগজ পত্র যাচাই ও তার বক্তব্য নিতে গেলে তাকে বিদ্যালয়ে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোন ও মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে অভিযোগ ও বিভিন্ন প্রশ্নের বৈধ কাগজপত্র চাওয়া হলে তিনি প্রতিবেদককে কোন কাগজ পত্র দেননি।

তবে তার স্বাক্ষরিত বিদ্যালয়ে দানকৃত একটি জমির কাগজ এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। যেখানে ২০১৫ সালে ২০১৪, ২০২২ ও ২০৫৪ তিন দাগে ২৪ শতক জমি তিনি বিদ্যালয়ের নামে দান করেছেন। যদিও এরফান আলী এ কাগজের সত্য মিথ্যা কোনটাই যাচাই করতে দেননি এবং এ কাগজ তাকে পাঠালেও কোন জবাব দেননি।

স্থানীয়দের দাবি এরফান আলী স্বাক্ষরিত কাগজে এই তিন দাগে উল্লেখিত জমিতে বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন, অফিস কক্ষ ও একটি পুকুর রয়েছে। তাদের প্রশ্ন চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০১৩ সালে জাতীয়করণ হলে ২০১৫ সালে এরফান আলীর দানকৃত জমিতে নির্মিত বিদ্যালয়টি কিভাবে জাতীয় করণ হয়? ব্যাক্তিগত জমিতে নির্মিত বিদ্যালয় কি জাতীয়করণের আওতায় আসতে পারে? যদি তা না হয়! এ বিষয়টি বিভাগীয় তদন্ত চান এলাকাবাসী।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলীর দাবি তিনি কোন বিদ্যালয় সরাননি। তার দাবি ২০০১ সাল থেকে অদ্যাবদি নিজের স্থাপিত চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করে আসছেন।

কিন্তু কাগজে কলমে দেখা যাচ্ছে ২০০৮ সালে ২৭ ডিসেম্বর এরফান আলী চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেছেন এবং একই বছরের পহেলা ডিসেম্বরে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেছেন। যদিও তার শিক্ষাগত সনদপত্র নিয়ে সন্দেহ আছে এলাকাবাসীর। স্থানীয়দের প্রশ্ন ২০০৮ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করলে এবং সে বছরে চাকরিতে যোগদান করলে ২০০১ সাল থেকে কোথায় শিক্ষকতা করেছেন তিনি ?

তৎকালীন চরভিটা বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আলতাফুর রহমান বলেন, যখন স্কুল ঘরটি ভাঙ্গা হয় তখন আমরা এরফান আলীর ভয়ে ছিলাম। এরফান সব সময় আমাদের মামলার ভয় দেখাতো। তবে শেষ পর্যন্ত আমি সাহস করে এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেছি। বিদ্যালয় জাতীয় করণ হবার আগে আমরা যত নথিপত্র তৎকালীন রাজশাহী বোর্ডে প্রেরণ করেছিলাম তার নথি কিভাবে যেন গায়েব হয়ে গেছে। আমরা বর্তমান চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারের নিয়ম মেনে হয়েছে কিনা তার সত্যতা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে জানতে চাই। এ বিষয়ে আমি উপজেলা প্রশাসনকে অভিযোগ পত্র দিয়েছি।

বাংলাদেশ তেল-গ্যাস-খনিজ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষার জাতীয় কমিটির ঠাকুরগাঁওয়ের সদস্য সচিব মাহবুব আলম রুবেল বলেন, স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকারের শাসন আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে অনেক অপরাধীই বৈধতা পেয়েছে । চরভিটা সরকারি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়েছে কিনা অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন। অনিয়ম হয়ে থাকলে এর পেছনে কারা কারা জড়িত তাদেরও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোফাজ্জল হোসেন বলেন, চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিষয়ে আমি একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি এবং উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে তদন্তের নির্দেশও দিয়েছি ইতোমধ্যে।

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button