টানা বর্ষণ : মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে জেলার ৪ টি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে । লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে। ত্রাণের অপ্রতুলতায় সরকারী সাহয্য পাচ্ছেন না দুর্গতরা। বাড়ছে জন দুর্ভোগ। হাওর জনপদের বাসিন্দাদের নাখাল অবস্থা। বন্যায় ডুবছে রাস্তা-ঘাট ঘর-বাড়ি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এনিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ । সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে জেলার হাকালুকি হাওর পারের কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ি উপজেলার ১৬টি ও কাওয়াদীঘি হাওর জনপদের রাজনগর উপজেলার ৩ টি ইউনিয়নসহ মোট ১৯টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে।
ইতিমধ্যে অনেকেই ঘর-বাড়ি ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি আর আশ্রয় কেন্দ্রে। এ বছর পাহাড়ী ঢল আর অবিরাম ভারী বৃষ্টিতে কয়েক দফা বন্যা হয়। গত ক’দিনের টানা বৃষ্টিতে জেলার হাওরগুলো পানিতে টইটুম্বর।
এ নিয়ে চলতি বছরের ৩য় দফা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছেন হাওর পারের মানুষ। এ বছর কয়েক দফা বন্যায় সব হারিয়ে নিঃস্ব কৃষককূল। আগের দু’বারের বন্যায় ধান আর সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছিল। এখন বানের পানি গ্রাস করছে তাদের বসত বাড়ি। বানের পানিতে ঘর-বাড়ি নিমজ্জিত হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে দুর্গত এলাকার মানুষজন।
চৈত্রের অকাল বন্যায় বোরো ধান ,মাছ ও হাঁসের খামার হারিয়ে দিশাহারা হাওর পাড়ের মানুষ। স্মরণ কালে এমন বির্পযয় দেখেনি তারা। তিন দফা বন্যায় বেসরকারী হিসেবে ২ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর সংখ্যা আরো বাতে পারে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে লোকজন দিশাহারা হলেও আশার বাণী ছাড়া পর্যাপ্ত সরকারি ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না। এমন অভিযোগ বন্যা উপদ্রত দুর্গত মানুষের।
স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের অভিযোগ প্রয়োজনীয় ত্রাণ বরাদ্ধ না পাওয়ায় শূন্যহাতে তারা দুর্গত এলাকার মানুসের পাশে যাচ্ছেন না।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষি ও মৎস্যজীবী লোকজন জানিয়েছেন কয়েক মাসের মধ্যে বার বার বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে আউস ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আর বানের পানিতে ভেসে গেছে পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ। গবাদি পশুগুলোর খাদ্য সংকটও চরমে। গেল ক’দিনের টানা ভারী বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে আবারও মারাত্মক বন্যা কবলিত জেলার ৪ টি উপজেলার ১৯টি ইউনিয়ন ও পৌর শহরের অধিকাংশ মানুষ। এর মধ্যে অন্যতম বন্যা কবলিত জেলার কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ী ও রাজনগর উপজেলা। বন্যাকবলিত লোকজন জানালেন কিছুদিন আগের বয়ে যাওয়া বন্যায় তাদের কৃষিজমি ও মৎস্যখামার ডুবে গেলেও এখন ডুবছে তাদের ঘরবাড়ি। হাকালুকি হাওর পাড়ের ৩টি উপজেলার বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন শতাধিক পরিবারের লোকজন। পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় অধিকাংশ বন্যা কবলিত লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন তাদের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে।
কুলাউড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের শতভাগ বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই ক্ষতের দাগ মুছতে না মুছতে আবারও হাওর পারের মানুষ পড়েছে ভয়াবহ বন্যার কবলে। বিগত ২ সপ্তাহ থেকে পচাঁনব্বই ভাগ পানিবন্দী হাওর পাড়ের ভূকশিমইল ইউনিয়ন। এছাড়াও ভাটেরা, বরমচাল, কাদিপুর, জয়চন্ডী, ব্রাহ্মণবাজার ও পৌরসভার ৩টি ওয়ার্ডসহ সদর ইউনিয়নের দেখিয়ারপুর গ্রামের লোকজন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। উপজেলার ৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে অর্ধশত পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। গতকাল সরেজমিন ভূকশিমইল ইউনিয়নে গেলে দেখা যায়, বড়দল গ্রাামের খতিবুন বেগম তার সন্তান নিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছেন। সাংবাদিক শুনে এগিয়ে এসে তিনি বলেন, ঘরে ধান নেই ত্রান নেই এলাকার মেম্বার চেয়ারম্যানরা কাছে আসছেন না। একবেলা ঠিকমতো আহার জুটেনা আমাদের।
এ গ্রামের কামাল চৌধূরী জানান আমাদের নাখাল অবস্থা সরকারী কোন সাহায্য আসছে না। গ্রামের শতভাগ মানুষের বাড়ি-ঘরে পানি। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে রাস্তা ঘাটে পানি আর পানি। চরম দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ।
কথা হয় কারেরা গ্রামের জুবেল আহমদ,দীরেন্দের সাথে তারা জানান ২ সপ্তাহ ধরে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। জাবদা গ্রামের কুটি চাঁন মিয়া বলেন আমরা বড় কষ্টে আছি ভুকশিমইল ইউনিয়নের প্রতিটি বাড়ি ঘরে পানি।
এ চিত্র শুধু ভূকশিমইলে নয়, হাওর পারের সকল গ্রামের মানুষের মাঝে একই অবস্থা। জয়চন্ডী ইউনিয়নের গিয়াসনগর গ্রামের আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘কৃষি জমিতে দিন মজুর হিসাবে কাজ করতাম। এবছর বোরো তলিয়ে যাওয়ায় কাজ নেই। নিজের বাড়িটাও পানিবন্দি।
স্মরণকালের ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়া কুলাউড়া মানুষের এই দুঃসময়ে সরকারি অপ্রতুল ত্রাণের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাড়িয়েছেন সাহায্যের হাত। তারপরও শতভাগ ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি শতভাগ সরকারি কিংবা বেসরকারি ত্রাণ। ইউপি মেম্বার আব্দুল মালিক বলেন সরকারী ত্রাণের অপ্রতুলতা নিয়ে আমরা মানুষের কাছে যেতে পারছি না প্রশ্নবৃদ্ধ হওয়ার ভয়ে।
ভূকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান মনির জানান, অকাল বন্যা বোরো ধান হারানোর পর এবার ভয়াবহ বন্যার কবলে ইউনিয়নবাসী। ইউনিয়নে মোট ৬ হাজারের বেশি পরিবার রয়েছে। বোরো ফসল হারা আর বন্যায় শতভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ। ত্রাণের অপ্রতুলতায় আমরা ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক ও সাধারণ গরীবদের নিয়ে শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থায় আছি।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বি জানান, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে আসলে কুলাউড়ার মত অন্য উপজেলা এতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। সহজে হাওরের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় এ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
বড়লেখায় ভারি বর্ষণে শতাধিক গ্রাম পানিবন্দি রয়েছে। এলাকার বন্যা দুর্গত প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাওয়ায় অসহায় মানুষের আহাজারি বাড়ছে। বড়লেখা উপজেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা স্থায়ী হওয়ায় শিশুসহ অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন নানা ধরনের পানিবাহিত রোগে। গো- খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের দশঘরি, ভোলারকান্দি, রাঙ্গিনগর, বাড্ডা, ঝগড়ি, কঠালপুর, চরকোণা, তেরাকুড়ি, কাছলিয়া, বাগেরকোণা, ব্রাহ্মণের চক, উত্তর বাঘমারা, পাটনা গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান নছিব আলী জানান, সুজানগর ইউনিয়নের প্রায় ৪ হাজার মানুষ বন্যা দুর্গত আছেন। অভিযোগ রয়েছে পর্যাপ্ত ত্রাণ না এলেও যা আসে তা স্থানীয় সরকারদলীয় নেতারা প্রভাবিত করে তাদের মনোনীত দুর্গত নয় এমন অনেককেই ত্রাণের চাল দিতে চাপ প্রয়োগ করেন বিতরণকারীদের ।
জুড়ী উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির পুনরায় অবনতি ঘটেছে। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নেই বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজেলার জায়ফর, নগর পশ্চিম জুড়ী, সাগরনাল, ফুলতলা, গোয়ালবাড়ি, এই পাঁচটি ইউনিয়নের রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে ডুবে গিয়ে যান চলাচলপথ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এতে করে জনদুর্ভোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, জুড়ী উপজেলার প্রশাসনিক ভবনের প্রবেশ পথসহ অধিকাংশ রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়ে পড়েছে। মানুষের বাড়ি ঘরের রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় পানিবন্দি মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। গবাদি পশুর খাদ্য সংকটে পরে কৃষককুল দিশাহারা হয়ে পড়েছে। উপজেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কৃষকদের ফলানো শাক-সবজির জমিগুলোও তলিয়ে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছে জুড়ী উপজেলাবাসী। এখনি জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ সহায়তা না পেলে উপজেলার বন্যা কবলিত এলাকার বাসিন্দারা চরম দুর্যোগে পড়বে। এ দিকে রাজনগর উপজেলার হাওর পারের তিনটি ইউনিয়ন ফতেপুর, মু›সীবাজার, পাঁচগাও এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। শতাধিক বাড়ি ঘরে পানি রয়েছে।
বোরো ধানের পর আউস ধান ও সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি গ্রস্তরা জানালেন স্থানীয় হাওর ও নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাসে এমন দুর্যোগ। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী জানান আমাদের উজানে ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে, যে কারণে ত্রিপুরার কয়েকটি স্থানেও বন্যা দেখা দিয়েছে। ওই এলাকার পানি আমাদের দিকে আসে, যে কারণে আমাদের নদী ও হাওরে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুত্র: নয়া দিগন্ত