sliderস্থানীয়

জাফলংয়ে বালু-পাথর লুটে সর্বনাশ, নেপথ্যে কারা ?

সিলেট প্রতিনিধি: সিলেটের ‘প্রকৃতি কন্যা জাফলং’ এর (ইসিএ) আওতাভূক্ত এলাকায় হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাথর ও বালু উত্তোলন চলছে দীর্ঘদিন ধরে। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে জাফলং নদীর তলদেশের ৫০ থেকে ৬০ ফুট গভীর থেকে তোলা হচ্ছে পাথর।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিলেটের জাফলংয়ে ফোর, সিক্স, এইট, টেন সিলিন্ডার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।
এমন কাজে ব্যবহার করা প্রতিটি মেশিনই ভয়ঙ্কর। মাটির উপরের অংশ ভেদ করে নিচ থেকে পাথর তোলে এই মেশিনগুলো। একসময় এসব বোমা মেশিন দিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল জাফলং পাথর কোয়ারিতে। প্রায় দেড়যুগ আগের এই তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন পূরণ করতে সময় লেগেছিল অন্তত ১২ বছর। বিগত সরকারের সময় প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে জাফলং লুট ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল।

এদিকে, বিগত ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর এমনভাবে অবৈধ কাজ করা আর সম্ভব হয়নি। প্রথমে হাত দিয়ে, পরে শ্যালো মেশিনসহ নানা মেশিন দিয়ে কোয়ারির উপরের অংশ লুট করা হয়েছে। এখন আর উপরের অংশে বালু কিংবা পাথর নেই। সর্বশেষ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জাফলংয়ে এখন বসানো হয়েছে বোমা মেশিন। এই মেশিনের নাম শুনলেই আঁতকে উঠেন জাফলংবাসীও। বোমা মেশিনের তাণ্ডবে একসময় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল জাফলংয়ের বুক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাথর ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন-এমন কাজে বোমা মেশিনের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। ওরা মাটির গভীর থেকে পাথর তুলে আনে। এতে করে গভীরে ক্ষত দেখা দেয়। তৈরি হয় চোরাবালির। জাফলংয়ের মানচিত্রেরও পরিবর্তন ঘটে। যেটি ২০০৫ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তাণ্ডবে ঘটেছিল। আরেক যন্ত্রদানবের নাম হচ্ছে এক্সেভেটর। এই এক্সেভেটর দিয়ে ৩০ ফুট পর্যন্ত গভীর খনন করা যায়।

বর্তমানে অন্তত ৫টি স্থানে এই মেশিন দিয়ে বড় বড় গর্ত করে পাথর লুট করা হয়েছে। ৫ আগস্টের দিন বিকালে পতিত শেখ হাসিনা সরকারের পতনে দেশ জুড়ে চলছে উল্লাস। এদিকে জাফলংয়ে উল্লাসের পরিবর্তে শুরু হয় পাথর খেকোদের লুটপাট। তখনই জিরো পয়েন্টসহ গোটা কোয়ারির উপরিভাগে থাকা অন্তত দেড়শ’ কোটি টাকার পাথর মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে লুটপাট করা হয়। এমন ঘটনা জানাজানির পরে সেনা হস্তক্ষেপে লুটপাট তখন বন্ধ হয়েছিল। ওই সময় প্রশাসনের তরফ থেকে সমীক্ষা চালিয়ে বলা হয়েছিল প্রায় ১২৫ কোটি টাকা পাথর লুট করা হয়েছে। যে পাথরের কোনো ট্যাক্সই সরকার পায়নি। লুটের ঘটনায় পরিবেশ থেকে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় জেলা বিএনপি’র পদ স্থগিত নেতা রফিকুল ইসলাম শাহপরান, সেলিম জমিদারসহ চিহ্নিত পাথরখেকোদের আসামি করা হয়। একইসঙ্গে দলীয়ভাবে বিএনপি’র তরফ থেকেও পাথরখেকোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবু জাফলংয়ে পাথরখেকোরা পিছু হটেনি; বরং জাফলং কোয়ারিতে দ্বিগুণ গতিতে লুটপাট চালাতে থাকে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত ৫ মাসে জাফলং কোয়ারি থেকে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার বালু ও পাথর লুট করা হয়েছে। এখন তার কোয়ারির উপরের অংশে বালু ও পাথর নেই। এ কারণে পাথরখেকো চক্রের সদস্যরা কোয়ারিতে যন্ত্রদানব ফোর সিলিন্ডার বোমা মেশিন ও এক্সেভেটর নিয়ে লুটপাট চালাচ্ছে। এই লুটপাটে জাফলংয়ের তীরবর্তী খাসিয়া জুমপাড় হুমকির মুখে পড়েছে। এখন জুমের ভেতরের অংশে পাথর লুটপাট চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। এক্সেভেটরের তিনদিনের তাণ্ডবে দুলালের দোকান, ছাদ মেম্বারের বাঁধ ও খলিলের ঘরের নিকটবর্তী স্থানে ৪-৫টি বিশাল আকৃতির পুকুর খনন করা হয়েছে। পাথর লুটপাট করতে ওই এলাকা এখন পুকুরে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সর্বশেষ গত বুধবার(৮ জানুয়ারি)যখন গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন অভিযান শুরু করে তখন ওই এক্সেভেটরগুলো লুকিয়ে ফেলা হয়। তবে গত দু’দিন ধরে রাতের আঁধারে ফোর সিলিন্ডার বোমা মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে বলে নির্ভরযোগ্য এক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জানা গেছে-রাজু ড্রাইভারের বাড়ির সামনে নয়াবস্তির ৭-৮টি বোমা মেশিন ব্যবহার করা হয়। দু’রাতেই প্রায় কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জুমপাড়সহ আশপাশ এলাকার মানুষ। বোমা মেশিন রাত ১২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত চালানো হয়। এ কারণে বোমার শব্দে নয়াবস্তি, কান্দুবস্তির মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। জাফলং নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা প্রশাসনের।এখনো পুলিশ ও বিজিবি পুরোপরি সক্রিয় হতে পারেনি। গোয়াইনঘাট পুলিশের যারা জাফলংয়ে রয়েছেন তারাও সবকিছু না দেখার ভান করেন। পাথরখেকো চক্রের কাছে তারা অসহায় হয়ে পড়েন। প্রায় এক মাস আগে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন এক অভিযান চালিয়ে লুট করা বিপুল পরিমাণ পাথরসহ ৫০০টি নৌকা আটক করেছিল। পরে স্থানীয়রা সংঘবদ্ধ হয়ে নৌকাসহ ওই পাথরগুলো ছিনিয়ে নেয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের কর্মকর্তারা হামলার ভয়ে জাফলংয়ে অভিযান চালাতে যান না। প্রথম দিকে কয়েকটি অভিযান চালালে তারাও নীরব রয়েছে। ফলে বাধা ছাড়াই জাফলং থেকে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার বালু ও পাথর লুট করা হয়েছে।

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইদুল ইসলাম জানিয়েছেন, তার পক্ষ থেকে বুধবার কোয়ারিতে অভিযান চালানো হয়। এখন যেদিকে পাথর নিয়ে আসা হয় সেই স্থানে স্থায়ী ব্যারিকেড দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার প্রশাসনের নিয়োজিত ঠিকাদাররা ব্যারিকেড নির্মাণ করতে গেলে তাদেরকে হুমকি-ধমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।তিনি বলেন, প্রশাসনের সব অংশ একসঙ্গে কাজ না করলে লুট ঠেকানো সম্ভব নয়। এখন দিনের বেলা অভিযানের ভয়ে সবাই নীরব থাকে। আর রাতের বেলা তারা লুটপাট চালায়। এ নিয়ে কী করা যায় সেটি নিয়ে তারা চিন্তা-ভাবনা করছেন বলে জানান।

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button