sliderবিবিধশিরোনাম

চীনের প্রতিবেশী ভিয়েতনাম যেভাবে রুখে দিলো করোনা

তারিক চয়ন : চীন থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটারেরও কম দূরত্বের কমিউনিস্ট একনায়কতান্ত্রিক দেশ ভিয়েতনাম। করোনার আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত চীনের উহান থেকে এক ব্যক্তি তার ছেলেকে দেখতে ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় শহর হো চি মিন সিটিতে গেলে প্রথমবারের মতো দেশটিতে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ২৩ জানুয়ারি।
তা সত্ত্বেও বাস্তবিক অর্থেই গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়নি দেশে। প্রথমদিকে একটানা দীর্ঘ অনেকদিন একজনও মারা যায়নি করোনায়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ জনসংখ্যার ভিয়েতনামে (১০ কোটি) করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মাত্র ৩৫ জন যা বাংলাদেশে মৃত্যুর (৫০৭২) ১৪৫ ভাগের ১ ভাগ! আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ যেখানে বিশ্বে ১৫ তম, ভিয়েতনাম সেখানে ১৬৫ তম। আক্রান্তদের (১০৬৯) সিংহভাগই আবার সুস্থ (৯৯১) হয়ে উঠেছেন।
ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক অবস্থা, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কোনটাই আহামরি নয়। বলা চলে মধ্যমানের। কিন্তু কি করে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হল তারা?
ভিয়েতনামের একটি স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক, লাইফ কোচ ও ব্যবসায়িক পরামর্শক হিসেবে কর্মরত এবং উপকূলীয় ডা নাং শহরে বসবাসরত শারমিন নাহার বলছিলেন, দেশটির কড়া আইন এবং তার বাস্তবায়নের কথা, ‘এখানে সবাইকেই নিয়ম মেনে চলতে হয়। কেউ আইন লঙ্ঘন করলে এমনভাবে শাস্তি বা জরিমানা করা হয় যে দু-একজনকে দেখে বাকিরা শিক্ষা পেয়ে যায়।’
দেশটির উত্তরেই চীন।
দু’দেশের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক সম্পর্ক। কিন্তু বছরের শুরুতে, ভাইরাসটি সম্পর্কে চীনের দেয়া আশ্বাসের উপর অন্ধের মতো ভরসা করে বসে থাকেনি দেশটি; বরং মহামারি ছড়ানোর আশঙ্কা কতটুকু, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চালিয়েছে।
করোনায় চীনের উহানে প্রথম মৃত্যুর পর দিন অর্থাৎ ১১ জানুয়ারি থেকে বিমানবন্দরের সব যাত্রীদের স্ক্রিনিং শুরু করে ভিয়েতনাম। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে কেউ এলেই কোয়ারেন্টিন আবশ্যক করা হয়। ১৫ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কৌশল তৈরি করার জন্য বৈঠক করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় স্কুল। জানুয়ারি শেষ হওয়ার আগেই ন্যাশনাল রেসপন্স প্ল্যান তৈরি করা হয়, ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটিও কাজে লেগে পড়ে।
ফেব্রুয়ারি, মার্চে ফ্লাইট নিয়ে আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। চীন ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মার্চ মাসের মাঝামাঝি এসে ভিয়েতনাম দেশটিতে ঢোকা প্রত্যেক মানুষকে এবং দেশের ভেতর পজিটিভ শনাক্ত হওয়া রোগীর সংস্পর্শে আসা প্রত্যেককে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। মার্চ মাসের শেষ দিকে সকল আন্তর্জাতিক ফ্লাইট তথা বিদেশিদের ঢোকা বন্ধ করে দেয়। দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হয়েছিল এপ্রিলে। তবে মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকেই স্থানীয়ভাবে লকডাউন শুরু হয়ে গিয়েছিল।
“শুরুতেই সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। সীমান্ত এবং অন্যান্য নাজুক জায়গাগুলোতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাড়িয়ে দেয়া হয়। সরকার বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে জনগণকে রাখে ঘরবন্দী। আক্রান্তদের শনাক্ত করে রাখে আইসোলেশনে। তারই সুফল পেয়েছে ভিয়েতনাম”, শারমিন বলছিলেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এর বিবৃতিতেও শারমিনের কথার সুর “অন্যান্য দেশের তুলনায় ভিয়েতনামের আর্থিক ক্ষতি কম হবে। এর অন্যতম কারণ, দেশের নেতৃত্ব দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং সাফল্যের সঙ্গে দেশ ‘আনলক’ করতে পেরেছে।”
ভিয়েতনামের প্রশংসা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বলেছিলেন, ভাইরাসটি বিস্তারের প্রাথমিক পর্যায়েই তা মোকাবেলায় দেশটির সরকারের নেয়া নানা জরুরি পদক্ষেপ বেশ ভালোভাবে কাজ করেছে।
তবে এর জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে দেশটিকে, মূল্য দিতে হয়েছে ঢের। যে ধরনের কঠোর পদক্ষেপ তারা নিয়েছিল, তার নেতিবাচক অনেক দিকও ছিল। কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং অর্থাৎ সংক্রমিত কারো সংস্পর্শে কারা কারা এসেছে তা খুঁজে বের করতে ব্যাপক জনশক্তি নিয়োগ করতে হয়েছিল। প্রচুর অর্থও ব্যয় করতে হয়েছিল। জানুয়ারি মাসের শুরুতে, যখন দেশটিতে একজনেরও করোনা শনাক্ত হয়নি, তখনই ভিয়েতনাম সরকার “চরম পর্যায়ে পদক্ষেপ” নেয়া শুরু করে। তখন উহানে মারা গেছে মাত্র দুজন। সেই পর্যায়েই তাদের প্রস্তুতির শুরু! সরকার করোনা মোকাবেলায় সমস্ত অঞ্চলকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ এই তিন ভাগে ভাগ করে দেয়।
তিন মাসের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাসাবাড়ির বিদ্যুৎ বিল শতকরা ১০ ভাগ কম নেয়া হয়। ফেস মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে ৫-১০ ভাগ কমিয়ে দেয়া হয়। মহামারী শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের পিপিই’র উপর থেকে ট্যাক্স উঠিয়ে নেয়া হয়। সারাদেশে নাগরিকদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা জানার জন্য মোবাইল এ্যাপ চালু এবং তা হালনাগাদ করতে বলা হয়। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে এবং গণপরিবহনে ভ্রমণকারীদের জন্য তাদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক করা হয়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যান্য দেশে এখনও সংক্রমণ ও মৃত্যু ব্যাপক মাত্রায় বাড়ছে, কিন্তু ভিয়েতনাম এর ব্যতিক্রম। কারণ গোড়ার দিকেই সংক্রমণের হার যখন কম ছিল, তখনই তারা দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে এবং পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে।
১লা সেপ্টেম্বর থেকে ভিয়েতনামে যে কেউ প্রবেশ করলে তাকে ‘কোয়ারেন্টিন’ ফি পরিশোধের নিয়ম চালু করা হয়েছে।৷ বিদেশি কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা খরচ ওই ব্যক্তিকেই বহন করতে হবে। কিন্তু ভিয়েতনামের নাগরিকদের জন্য সে খরচ বহন করবে সরকার।
সুত্র : মানবজমিন

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button