slider

চিকিৎসা বঞ্চিত চরের মানুষের দুঃখগাঁথা

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি: স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। তবে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা নদীর বুকে জেগে ওঠা তিন ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ। এ চরের অন্তত ১৮ হাজার মানুষের জন্য নেই কোনো হাসপাতাল। নেই কোনো চিকিৎসক। সর্বরোগের জন্য কয়েকটি ফার্মেসি আর কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারই একমাত্র ভরসা। ফলে প্রায়ই বিনা চিকিৎসায় মারা যান রোগীরা।
   

হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, হরিরামপুর উপজেলায় পদ্মা নদীর ওপারে তিনটি ইউনিয়নে দুইটি কমিউনিটি ক্লিনিক আর দুইটি সাব সেন্টার ছিল। এর মধ্যে ২০২২ সালে আজিমনগর ইউনিয়নের সাব সেন্টারটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। একটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্সও ছিল চরাঞ্চল থেকে রোগীদের দ্রুত নদী পারাপারের জন্য। কিন্তু এখন সেটি নিজেই মুমূর্ষু।
   

সরেজমিনে দেখা যায়, হরিরামপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের জন্য দুইটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও একটি সাব সেন্টার রয়েছে, আর আজিমনগর ইউনিয়নের একটি সাব সেন্টার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দুইটি কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রতিদিন সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও সপ্তাহে মাত্র একদিন খোলা হয়। আর বাকি পাঁচদিন থাকে তালা। এর মধ্যে হরিহরদিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বে থাকা কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার রাশেদ মিয়ার স্থানীয় পাটগ্রাম বাজারে ফার্মেসি রয়েছে, তিনি বেশিরভাগ সময় সেখানেই দেন স্থানীয়দের অভিযোগ, রাশেদ মিয়া মাঝে মাঝে আসেন কমিউনিটি ক্লিনিকে। বেশিরভাগ সময় তিনি ফার্মেসিতেই থাকেন।
   

এদিকে আন্ধারমানিক ঘাটে দেখা যায়, কাত হয়ে পড়ে রয়েছে নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটি। সামনের গ্লাস ও যন্ত্রপাতি ভাঙা। ভেতরে রোগী শোয়ার এবং রোগীর স্বজনদের বসার সিট নেই। পানি, শ্যাওলা ও কাদায় নোংরা হয়ে আছে পুরো অ্যাম্বুলেন্সটি। হালসহ বিভিন্ন জায়গায় মরিচা ধরেছে।
   

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, বছরের পর বছর নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটি পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। চরাঞ্চলবাসীর কোনো কাজেই আসেনি এটি। চরাঞ্চলের মানুষ আন্ধারমানিক ও বাহাদুরপুর ঘাটের ট্রলারে পারাপার হয়ে থাকে। রাতে কারও চিকিৎসা বা অন্য জরুরি প্রয়োজনে ঘাটের মাঝিদের ফোন দিলে তারাই পার করেন তাদের।।তিনটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কী, সেটিই জানেন না এই চরের অধিকাংশ নারীরা। গর্ভকালীন সময়ে করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কেও নেই তাদের প্রয়োজনীয় ধারণা। বংশ পরম্পরায় দাদি-নানিদের কাছ থেকে যা জেনেছেন তা নিয়েই চলছে এই চরের নারীদের জীবন। সকল প্রকার রোগের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসা এলাকার ফার্মেসিগুলো। অসুস্থ হয়ে পড়লে পাড়ি দিতে হয় দুর্গম পথ ও খেয়া নৌকায় পার হতে হয় ভয়াবহ পদ্মা নদী। কেউ কেউ নদীতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন অধিক সময় লাগার কারণে। তাও আবার সন্ধ্যা ৬টার পর বন্ধ হয়ে যায় সেই খেয়া পারাপার।
 লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ পাটগ্রামে এলাকার শামেলা বেগম এক বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমার বেটার বউ গর্ভবতী আছিল, পরে ওপার নেওয়ার সময় মধ্যনদীতেই মারা গেছে।’
   

চরাঞ্চলের বাসিন্দা তাসলিমা আক্তার এক বাচ্চার মা। তিনি বলেন, ‘চরে নাই হাসপাতাল। কোনো গাইনি ডাক্তার নেই। মেয়েদের গর্ভকালীন অবস্থায় অনেক সমস্যা হয়। ওই অবস্থায় কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না। আমাদের দেশগ্রামে চাউনি (দাই) আছে, কিন্তু তারা অতকিছু বোঝে না। তাদের কাছেতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কোনো কিছু থাকে না। তারা যতোটুকু পারে, চেষ্টা করে। ডাক্তার না থাকার কারণে অনেক সময় বাচ্চা মারা যায়, নয়তো মা মারা যায়।’
 

স্থানীয় পান্নু হোসেন বলেন,‘আমার বউয়ের সাত মাস চলে। আমাদের চরাঞ্চলে কোনো হাসপাতাল নাই, কোনো ডাক্তার নাই। কোনো জায়গায় নিতে হলে আমাদের চরাঞ্চল থেকে অনেক কষ্ট যাতায়াত করা লাগে। নদীপথে যেতে হলেও সময়মতো নৌকা পাওয়া যায় না। সময়মতো না যেতে পারার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। আমাদের চরে যদি একটা হাসপাতাল থাকতো, যদি ডাক্তার থাকতো, আমাদের জন্য ভালো হতো।’
 

হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কাজী এ. কে. এম. বলেন, আমাদের হরিরামপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন চরাঞ্চলে। সেখানে দুইটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও একটি সাব সেন্টার রয়েছে। আরেকটি সাব সেন্টার ২০২২ সালে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তাছাড়া একটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্স ছিল সেটা ২০২২ সাল থেকে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছি।
   

হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কোহিনুর আক্তার বলেন, চরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি আমরা বিভিন্ন মহলে জানিয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠির মাধ্যমেও জানানো হয়েছে। আর নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটি আমিও দেখেছি অকেজো হয়ে আন্ধারমানিক ঘাটে পড়ে আছে। ওটা এখন আর ঠিক করার অবস্থায় নেই। ইউনিয়ন কমিউনিটি ক্লিনিকের বিষয়ে খবর নিয়ে দেখবো, কেউ যদি দায়িত্বে অবহেলা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button