sliderশিরোনামশীর্ষ সংবাদ

চিংড়িই ধ্বংস করে দিচ্ছে ইলিশ!

চিংড়ি ও ইলিশ – বাঙালির খাবার পাতে এই দুটোই খুব প্রিয় মাছ, কিন্তু চিংড়ি চাষের দাপটেই না কি ইলিশ ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। অন্তত ভারতের কলকাতার একটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় এমনটাই দাবি করা হয়েছে।
ইলিশ কেন বিপন্ন, তা নিয়ে করা গবেষণাটিতে বলা হচ্ছে, মাছের ভেড়িতে একটামাত্র বাগদা চিংড়ি তৈরি করতে নষ্ট হচ্ছে প্রায় শ’চারেক ইলিশের ডিম। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা বিবিসিকে বলেছেন, ইলিশকে বাঁচাতে হলে মোহনার কাছে বা অগভীর সমুদ্রে বিশেষ ধরনের কিছু জাল নিষিদ্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
গবেষণাটি করেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওশানোগ্রাফিক স্টাডিজ বা সমুদ্রবিদ্যা বিভাগ। ওই বিভাগের অধিকর্তা সুগত হাজরা বলছিলেন – প্রথম পর্যায়ের গবেষণায় তারা দেখেছেন, সমুদ্র থেকে নদীতে ডিম পাড়তে আসা ইলিশদের জন্য প্রধান বিপদ হল শ্যালো ট্রল নেট এবং চিংড়ি চাষে ব্যবহৃত মশারি জাল ও বেহুন্দি জাল।
স্থা আইইউসিএনের অর্থায়নে ও বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে আমরা ইলিশের আবাসভূমি, মাইগ্রেশন ও সেখানে মানুষের তৈরি করা বাধা কী রয়েছে তা স্টাডি করেছি। তাতে দেখা গেছে ‘বটম ট্রলিং’য়ের জন্য যে ট্রল নেট ব্যবহার করা হয় সেটা ইলিশের জন্য একটা বিরাট হুমকি।’
‘এমনিতে ট্রল নেট কিন্তু বড় বড় ফাঁকেরই জাল। কিন্তু যেটা হয়, টানার সময় এর তলার দিকের ফাঁকগুলো আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যায় – ফলে এর নিচে সব সময়ই প্রচুর মাছ ও মাছের পোনা নষ্ট হয়। এ কারণেই আমরা বলেছি তিরিশ থেকে পঞ্চাশ মিটার পর্যন্ত অগভীর সমুদ্রে ট্রল নেট এবং সেই সঙ্গে চিংড়ির পোনা ধরার বেহুন্দি ও মশারি জাল নিষিদ্ধ করতে হবে।’
ইলিশের চালান যে বিপজ্জনকভাবে কমছে – এবং তুলনায় বাড়ছে চিংড়ির জোগান সেটা বোঝা যায় পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী রয়্যাল সি ফুডসের মমতাজ আহমেদের সঙ্গে কথা বললেই। মি আহমেদ বেশ কয়েক বছর হল ইলিশের কারবার ছেড়ে পুরোপুরি চিংড়ি সরবরাহ ও রফতানির ব্যবসায় ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছেন।
‘বাজারে ইলিশ এখন ভীষণ কমে গেছে – গত বছর পাঁচেক ধরে আমি তো বলব আগের তুলনায় ইলিশ প্রায় পঁচিশ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে আমরা ইলিশ এখন বন্ধই করে দিয়েছি – দেশেবিদেশে শুধু চিংড়িটাই পাঠাচ্ছি’।
আসলে ভেড়িতে চিংড়ির পোনা জোগান দিতে গিয়ে বহু জেলে নিজের অজান্তেই ইলিশের মৃত্যু ডেকে আনছেন – বলছিলেন গবেষক দলটির প্রধান সুগত হাজরা।
‘ইলিশ যে কতটা বিপন্ন তা বোঝা যায় যখন দেখছি মোট ধরা পড়া ইলিশের আশি শতাংশেরই ওজন তিনশো গ্রাম বা তার কম। আশির দশকের আগে কিন্তু ইলিশ এতটা বিপদের মুখে ছিল না – কিন্তু সে সময় থেকে চিংড়ি চাষের রমরমা শুরু হয়, আর ইলিশের বিপদ ঘনিয়ে আসে’।
‘সাধারণ মানুষ মশারির জাল, বেহুন্দির জাল দিয়ে চিংড়ির পোনা ধরে তা অ্যাকোয়াকালচার ফার্ম বা চিংড়ির ভেড়িতে বিক্রি করেন। কিন্তু ওই জাল দিয়ে চিংড়ির পোনা ধরতে গিয়ে তারা অসংখ্য ইলিশের ডিম, ছোট ইলিশ ও আরও নানা মাছের চারা না-জেনেই নষ্ট করে ফেলেন’।
‘এমনও দেখা গেছে সারা দিনের শেষে পাঁচ শ’ টাকায় মাত্র একটা হরজাই মাছ বিক্রি করতে গিয়ে প্রতিটা বেহুন্দি জাল-পিছু হাজার হাজার ইলিশের চারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক এটা আমাদের বন্ধ করতেই হবে’, বলছেন ড: হাজরা।
আর সেই কারণেই ভারত সরকারের কমিশন করা এই দ্বিতীয় পর্যায়ের গবেষণার শেষে তারা সুপারিশ করছেন – বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও ইলিশের জাটকা ধরা বন্ধ করতে হবে, দরকারে জেলেদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, ইলিশ যেখানে ডিম পাড়ে এমন পাঁচটি চিহ্নিত এলাকায় ব্রিডিং সিজনে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে – এবং অবশ্যই মোহনার কাছে নিষিদ্ধ হতে হবে মশারি বা বেহুন্দি জাল।
নইলে মাত্র তিরিশ থেকে চল্লিশ বছরের মধ্যে ইলিশের প্রজাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে ও বাঙালির পাত থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে বলেই তারা আশঙ্কা করছেন!
সূত্র : বিবিসি

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button