slider

ঘোড়াচালকের ছেলে, ছাপাখানার শ্রমিক থেকে কোটিপতি ইউপি চেয়ারম্যান

হরিরামপুর প্রতিনিধি: চরাঞ্চলের খাস ও রেকর্ডীয় মালিকানার জমি দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ ভূমিহীনদের কাগজ করার আশ্বাস ও আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্দ দেওয়ার নামে আদায় করেছেন অর্থ। আওয়ামী শাসনামলের ১৫ বছরে দলীয় পদ লাগিয়ে ও নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান হয়ে ছাপাখানার শ্রমিক থেকে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

তিনি হলেন মানিকগঞ্জের পদ্মা অধ্যুষিত অন্যতম উপজেলা হরিরামপুরের চরাঞ্চলের আজিমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেন। তার অন্যতম সহযোগী সহোদর যুবলীগ নেতা মুসা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আজিমনগর ইউনিয়নের পূর্ব আজিমনগর বাইরডাংগি গ্রামের ঘোড়াচালক আলিমুদ্দিন বেপারীর ছেলে মো. বিল্লাল হোসেন। আশির দশকের শেষদিকে নদীভাঙনের কবলে পড়ে আজিমনগর থেকে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জের জয়কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের চারাখালি গ্রামে বসবাস করেন। সেখানেও পদ্মার ভাঙনের কবলে পড়লে ৯৮ সালে আজিমনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খান তাদের বসন্তপুর এলাকায় সরকারি কলনিতে একটি ঘর বরাদ্দ দেয়। বাবা আলিমদ্দিন খেয়া পারাপার ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।

তিনি চরে ঘোড়ার গাড়িতেও মালামাল বহন করতেন। বিল্লাল হোসেন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করে বাবার কাজে সহযোগিতা করতেন। পরবর্তীতে তিনি ওই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আলী আকবর খানের পুরান ঢাকার ছাপাখানা সুইটি প্রেসে চাকরি নেন। কয়েক বছর কাজ করে ছাপাখানার চাকরি ছেড়ে তিনি জর্দ্দার ফ্যাক্টরি দেন। এতে লাভবান না হওয়ায় পরবর্তীতে তিনি স্বর্ণের বক্স তৈরিরও কারখানা দেন বলে জানা যায়।

স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, আওয়ামী শাসনামলে তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় নৌকা প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ওপরে উঠার সিঁড়ি পান। এর পাশাপাশি তার ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন মুসা পান ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতির পদ। এরপর দুইয়ে মিলে চরাঞ্চলে গড়ে তোলেন বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী।

চেয়ারম্যান বিল্লাল, তার ভাই মোশাররফ ও তাদের অনুসারীরা মিলে চরাঞ্চলের বিভিন্ন পরিবারের প্রায় ৪শ বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে চাষাবাদ করেন।

এ ছাড়াও ভূমিহীনের জমির কাগজ করে দেওয়ার নামে প্রায় ২৫০ জনের কাছ থেকে ১০ হাজার ২০০ টাকা এবং বসন্তপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়ার নামে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয় বিল্লাল চেয়ারম্যান ও তার ভাই মুসা। অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েও ঘর দেননি এবং টাকাও ফেরত দেননি।

টাকা চাইলে ভুক্তভোগীদের হুমকি-ধামকি দিতেন বলেও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। তার বিশাল বাহিনীর মাধ্যমেই বিরোধী পক্ষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি ও ভূমি দখল করে আসছেন তিনি। এতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লেও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর কারণে এতদিন স্থানীয়রা মুখ খোলার সাহস পাননি।

গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ফুঁসে উঠেছেন চরাঞ্চলের স্থানীয় শত শত ভুক্তভোগী পরিবার। সামনে আসে গাড়োয়ানের পুত্র কোটিপতি বিল্লাল চেয়ারম্যানের ক্ষমতার সাত বছরের ফিরিস্তি।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেনের ঢাকার কেরানীগঞ্জে ছয়তলা নিজস্ব বাড়িসহ একাধিক প্লট রয়েছে। এ ছাড়া চরাঞ্চলের বসন্তপুরে সরকারি কলোনির জায়গায় রয়েছে বিলাস বহুল তিনতলা বাড়ি। অশিক্ষিত হলেও অল্প দিনে কোটিপতি বনে যাওয়া বিল্লাল হোসেন চলাফেরা করেন নিজস্ব প্রাইভেট কারে।

সম্প্রতি সরেজমিনে চরাঞ্চল আজিমনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গেলে শত শত সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

বসন্তপুর এলাকার তাহের মোল্লা জানান, ‘আমার একটি ৮ বিঘার পুকুরসহ ২৫ বিঘা সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে বিল্লাল চেয়ারম্যান ও তার ভাই মোশারফ হোসেন। পরবর্তী সময়ে আমার বাড়ির পাশে, আমার আরও দেড় বিঘা জমিতে জোরপূর্বক মুরগির ফার্ম দিয়েছে তারা। এতে আমি বাধা দিলে আমাকে আমার বাড়ি থেকে উচ্ছেদসহ এলাকায় থাকতে দিবে না বলে হুমকি দিয়ে আসছে। তাই সরকারের কাছে আমি এর বিচার চাই।’

ইব্রাহিমপুর গ্রামের শহীদ মৃধা বলেন, ‘আমি হাতিঘাটা মৌজায় ১৪/১৫ বিঘা জমিতে বর্গা চাষ করতাম। সে জমিগুলো ২০১৬ সালে বিল্লাল চেয়ারম্যান হওয়ার পর তার লোকজন দিয়ে এগুলো দখল করে যায়। তারপর আমি আসি নছরতপুরের মৌজায়। সেখানেও আমার কটে রাখা ৩৫ বিঘা জমি বিল্লালের ভাই মোশারফ ভোগদখলে নিয়ে যায়। তাই আমি সরকারের কাছে বিচার চাই, আমাকে যেন আমার জমিগুলো চাষাবাদ করার ব্যবস্থা করে দেয়।’

ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. জাহাঙ্গীর শিকদার জানান, আমার মেম্বারের বয়স ২ বছর ৮ মাস। এই দুই বছর ৮ মাসে একদিনও আমি পরিষদে যেতে পারিনি। পরিষদের কোনো বেতন, রিলিফ, রেশন বা যাই কিছু আইছে আমাকে কোনো খোঁজখবর দেয়নি এবং কোনো মিটিংয়েও আমাকে যাইতেও দেয়নি।

এ ছাড়া চেয়ারম্যান বছরে একটা মিটিংও করে নাই। আমি চল্লিশ বছর ধরে একটা জমি খাই। সেখানে বিল্লালের সন্ত্রাসী বাহিনী জমি দখল করে আমার বাড়ির পালান পর্যন্ত কলাগাছ লাগিয়ে দখলে নিয়েছে। এ ছাড়া আমি ৮ বছর ধরে বাড়িতে থাকতে পারি নাই, ঘুমাতে পারি নাই। আমার চাকরিজীবী ও ভার্সিটিতে পড়ুয়া দুইটা ছেলেকেও মিথ্যা মামলা দিয়ে এলাকায় ঢুকতে দেয়নি। তাই আমি সরকারের কাছে বিচার চাই, আমার অর্থনৈতিকভাবেও যে জমিগুলা তারা দখল করে নিয়েছে তা যেন আমাকে ফিরিয়ে দেয়।

৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার শামসুদ্দিন জানান, ‘আমি বিগত ৩২ বছর মেম্বারি করেছি। গত বছর আমি নির্বাচনে ফেল করি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, আমাদের জালালদি গ্রামের একশো পরিবারের ভুট্টার ধরন্ত ফসল এই বিল্লাল বাহিনীর লোকজন লুটপাট করে নিয়ে আসে।’

এ ছাড়া বিল্লাল বাহিনীর কাছে বিভিন্ন ধরনের বড় বড় ছেন (ধারালো অস্ত্র), রাম দা, কুড়ালসহ অস্ত্র আছে বলেও দাবি করেন তিনি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে এনায়েতপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী জানান, আমাকে বিল্লাল চেয়ারম্যান চাঁদাবাজি, গাড়ি ছিনতাইসহ প্রায় অর্ধশতাধিক মিথ্যা মামলা দেয়। যার ভিতরে ইতোমধ্যে আমি বেশ কয়েকটি মামলার রায় পাইছি। এসব মামলায় আমাকে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি করেছে এই চেয়ারম্যান ও তার বাহিনী। এতে আমার সংসারটা ধ্বংস হয়ে গেছে।

এ ছাড়া আমার পৈতৃক জমিতে ভুট্টা চাষ করলে, সেখানে বছরে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। পরে আমি সুদে ৫০ হাজার টাকা এনে বিল্লাল বাহিনীর সদস্য এনায়েত, আতি, মতি ও মুসার কাছে দিলেও বাকি টাকার জন্য চাপ দিতাছে। তাই আমি মিডিয়ার মাধ্যমে সরকারের কাছে এ বিষয়গুলো তদন্ত করে কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

শিকারপুর আদর্শ গ্রামের ওবায়দুল খান জানান, বিল্লাল চেয়ারম্যানের ছোটভাই মেশারফ হোসেন মুসা আমার কাছ থেকে ঘরের কথা বলে এক লাখ টাকা দাবি করে। আমি ৭০ হাজার টাকা দিছি। বাকি ৩০ হাজার টাকা ঘর বুঝিয়ে দেওয়ার পর নেওয়ার কথা। আমাকে ঘরও দেয়নি। টাকাও ফেরত দেয়নি।

এ ছাড়াও ভূমিহীনদের তালিকা তৈরি করে সরকারি খাস জায়গার কাগজ করে দেওয়ার জন্য এই বিল্লাল চেয়ারম্যান আমার কাছে থেকে ১০ হাজার ২০০ টাকা নিয়েছে।

এ বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. বিল্লাল হোসেন জানান, ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কেউ একটা রিপোর্ট দিল না। হঠাৎ করে এতোগুলো অভিযোগ এলো? আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট।

এগুলো সব অবাস্তব কথা। আমার কোনো জমিজমা নেই, আমার ভাইও এই চরে কোনো জমি চাষাবাদ করে না। যা করে, সব ঢাকা ও ফরিদপুর জেলায়। আর ঘরের টাকা কেউ দেয় নাকি? এগুলোতে তো মানুষ এমনিই নিতে চায় না তারা গরু-ছাগল পালন করতে পারবে না বলে। দলিলই করাইতে পারি না মানুষকে দিয়ে।

আবার ভূমিহীনদের টাকার বিষয়ে হলো চরাঞ্চলে তো ভূমিহীন নাই। ভূমিহীন কি হইছে যে তার জন্য টাকা নিব? এগুলো আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে সাজিয়ে প্ল্যান করে বলানো হয়েছে।

বিল্লাল চেয়ারম্যানের ভাই ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি মোশারফ হোসেন মুসা বলেন, ‘আমি চরে শিকারপুর ও হরিয়া মৌজায় কিছু জমি বরগা চাষ করি। আর নছরতপুর মৌজায় আমার কিছু জমি আছে। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা, প্রতিহিংসার কারণে আমাদের হয়রানি করতে এসব অভিযোগ করেছেন।’

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহরিয়ার রহমান বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান হয়ে তিনি যদি এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে থাকে তাহলে তদন্ত করে প্রমাণিত হলে তাকে সাসপেন্ড করা হবে।

এছাড়া চাঁদাবাজির বিষয়ে কোর্টে মামলা করার পরে কোর্ট থেকে নির্দেশনা এলে আমরা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারব। আর অস্ত্রের বিষয়ে আমি এখনো পর্যন্ত কোনো তথ্য পাইনি, আপনার কাছ থেকেই জানতে পারলাম। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button