গ্যাস সঙ্কটের মধ্যেই আবারো আবাসিক খাতে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা
বাংলাদেশে চলমান গ্যাস সঙ্কটের মধ্যে আবাসিক খাতে মিটারবিহীন গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। গ্যাস সঙ্কটে মানুষ যখন হয়রান, তখন দাম বৃদ্ধির এ প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তারা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেনি, শুধু মাসিক গ্যাস ব্যবহারের ইউনিট সীমানা পুনঃনির্ধারণের প্রস্তাব করেছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তিতাসের প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাসের ইউনিট পুনঃনির্ধারণ করা হলে গ্যাসের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে।
এ প্রস্তাব কার্যকর হলে আবাসিক খাতে এক চুলার বিল ৩৮৯ টাকা বেড়ে হবে এক হাজার ৩৭৯ টাকা এবং দুই চুলার বিল ৫১২ টাকা বেড়ে হবে এক হাজার ৫৯২ টাকা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধিতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে গ্যাসের দাম আবার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় আছে তারা। গ্যাস সঙ্কটের মধ্যে এ ধরনের প্রস্তাবের দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তিতাসের দাবি, তারা দাম বাড়াতে নয়। বরং ‘সিস্টেম লস’ কমাতে এ প্রস্তাব দিয়েছে।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা।
এর আগে সবশেষ গত বছরের জুনে আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। তখন প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৮ টাকা।
এরপর চলতি বছর ১৮ জানুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বাণিজ্যিক খাতে আবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও বাসাবাড়িতে বাড়ানো হয়নি।
ওই হিসাবে বর্তমানে মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকের মাসিক বিল এক চুলার জন্য ৯৯০ টাকা ও দুই চুলার জন্য এক হাজার ৮০ টাকা দিতে হয়।
ওই সময় মিটার ছাড়া গ্রাহকদের জন্য মাসে গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ দুই চুলায় ৬০ ঘনমিটার ও এক চুলায় ৫৫ ঘনমিটার ধরে এ দাম নির্ধারণ করেছিল বিইআরসি।
গত ২ মে বিইআরসির কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে তিতাস অনুরোধ জানায়, যেন মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহক শ্রেণির একমুখি ও দ্বিমুখি চুলার বিপরীতে মাসিক গ্যাস ব্যবহার যথাক্রমে ৭৬.৬৫ ও ৮৮.৪৪ ঘনমিটার পুনঃনির্ধারণ করা হয়।
তিতাসের দাবি, বরাদ্দকৃত গ্যাসের তুলনায় আবাসিক গ্রাহকরা আরো বেশি পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করছে। এতে ‘সিস্টেম লস’ হচ্ছে।
তিতাস যা বলছে
তিতাসের দাবি, বর্তমানে ২৫ লাখ ২৫ হাজার চুলায় মিটারবিহীন গ্যাস সরবরাহ করে আসছে। এসব গ্রাহকের বিপরীতে কোনো সমীক্ষা বা তথ্য বিশ্লেষণ না করেই বিইআরসি ঘনমিটারের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে। এতে কারিগরি ক্ষতি বেড়েছে এবং সরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠান তিতাস আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
যেখানে আবাসিকে প্রয়োজন মতো গ্যাস মেলে না, সেখানে গ্যাস দাম বাড়ার আশঙ্কায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভাটারার বাসিন্দা কুলসুমা আক্তার।
তিনি বলেন, ‘সুযোগ পেলেই সবকিছুর দাম বাড়ানোর চেষ্টায় থাকে। কিন্তু আমরা তো গ্যাস পাই না। সারাদিনই চুলা বন্ধ। তারা গ্যাস দিবে না, লাইন ঠিক করবে না। খালি দাম বাড়ানোর কথা বলবে।’
দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে তিতাস গ্যাস লিমিটেডের কোনো কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার বলেছেন, তারা এ প্রস্তাব দিয়েছেন সিস্টেম লস বন্ধের জন্য, এর সাথে ‘দাম বাড়ানোর’ কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি বলেন, ‘বিইআরসি মিটারবিহীন এক চুলা ও দুই চুলার জন্য গ্যাস বরাদ্দ করেছে ৫৫ থেকে ৬০ ঘনমিটার, এই হিসাবটা করা হয়েছে প্রিপেইডে গ্যাস ব্যবহারের ভিত্তিতে। কিন্তু মানুষ প্রিপেইডে অল্প গ্যাস ব্যবহার করে আর মিটারের বাইরে অনেক গ্যাস ব্যবহার করে।
তিনি আরো বলেন, ‘সরকার বরাদ্দ করেছে ৫৫ থেকে ৬০ ঘনমিটার, বাস্তবে মিটারবিহীনে ব্যবহার হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ ঘনমিটার বা তারও বেশি। তার মানে ১৫ থেকে ৩০ ঘনমিটার গ্যাস লস যাচ্ছে। আমরা চাই এ লসটা কমুক। আমরা দাম বাড়ানো নিয়ে কিছু বলিনি। তিতাস শুধু গ্যাস বিতরণ করে আর ১৩ পয়সা হারে মার্জিন পায়। গ্যাসের দাম বাড়লে আমাদের কোনো লাভ নাই।’
যদিও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বলছে গ্যাসের বরাদ্দ বাড়ানো হলে দামও বাড়বে।
কমিশনের চেয়ারম্যান মো: নূরুল আমিন জানান, ‘তিতাস তাদের চুলায় কী পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার হয় সে বিষয়ে একটি পর্যালোচনা দিয়েছে। আমরা তাদের দাবি যাচাই-বাছাই করছি, তারপর নির্ধারণ করব।’
তিতাসের যুক্তি ও গ্রাহকদের স্বার্থ দুই বিষয় বিবেচনা করেই দামের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
প্রিপেইড মিটার সমাধান
এর সমাধান হিসেবে বিশেষজ্ঞরা আবাসিক গ্যাসের ব্যবহার শতভাগ প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার কথা বললেও ওই প্রকল্পে ধীরগতির কারণে লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) হিসাবে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার গ্যাস চুরি হচ্ছে। মিটার বসানো হলে এ চুরি ঠেকানো সহজ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
অথচ বাংলাদেশে কচ্ছপের গতিতে আগাচ্ছে প্রিপেইড গ্যাস মিটার বসানোর কাজ। অর্থায়নের অভাবে মিটার দেয়া হচ্ছে না এবং নতুন আবেদনও নেয়া হচ্ছে না।
প্রিপেইড মিটার বসানোর এ ধীরগতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিইআরসির চেয়ারম্যান নূরুল আমিন বলেন, প্রিপেইড মিটার বসানোর ক্ষেত্রে বাজেট একটা বড় ইস্যু। এ জন্য যে পরিমাণ অর্থ দরকার, তা ছাড় না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্ব হচ্ছে।
প্রিপেইড মিটারে বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নিশ্চিত হলে পরিকল্পনা এগিয়ে যাবে বলে তিনি জানান।
তবে তিতাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ইতোমধ্যে আড়াই লাখ প্রিপেইড মিটার বসানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছে। একনেকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস হয়েছে বলেও জানানো হয়।
মিটার বসানোর জন্য সরকার যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল তা সরকারের বিনিয়োগে অনিচ্ছার কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন জ্বালানিবিষয়ক সাময়িকী এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ারের সম্পাদক মোল্লা আমজাদ।
তিনি বলেন, সরকারকে প্রতিটি মিটার বাবদ ১০০ থেকে ১৫০ ডলার গুনতে হবে। অর্থাৎ বিশাল অংকের বাজেট। যেহেতু সরকার দীর্ঘমেয়াদে গৃহস্থালিতে গ্যাস সরবরাহ করবে না বলে জানিয়েছে, তাই তারা এই বরাদ্দ দিতে চাইছে না।
তিতাসের বিনামূল্যে প্রিপেইড মিটার সরবরাহের সক্ষমতা নেই। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ঋণ দিতে চাইলেও সরকার তা বাতিল করে দেয় বলে তিনি জানান।
এক্ষেত্রে মোল্লা আমজাদের পরামর্শ, গ্যাস বিতরণী কোম্পানিগুলো মিটারের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে যেন গ্রাহকরা তাদের সুবিধামতো কিনে তা বসিতে নিতে পারে।
এক্ষেত্রে আবাসিক গ্যাসের ন্যায্য দাম নির্ধারণ করা জরুরি বলেও তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশে ২০১১ সালে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে প্রিপেইড মিটার বসানোর কাজ শুরু করে তিতাস। ওই সময় অল্পকিছু মিটার বসানো হলেও পরে জাপানের দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে প্রিপেইড মিটার বসানোর কাজ শুরু হয়।
পরে ২০১৯ সালে বিইআরসি একটি পরিপত্রের মাধ্যমে সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটার বসানোর নির্দেশনা দেয়। ২০২৪ সালের মধ্যে সব আবাসিক গ্রাহককে প্রিপেইড সিস্টেমের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
নির্দেশ থাকা স্বত্বেও বাস্তবে আবাসিক গ্রাহকদের মাত্র ১০ ভাগ চুলায় প্রিপেইড মিটার বসেছে বলে বিইআরসি সূত্রে জানা গিয়েছে।
শুরুতে অনেকেই প্রিপেইড মিটার বসাতে আগ্রহী হননি। কিন্তু আবাসিকে প্রিপেইড মিটার বসানোর পর গ্যাস ব্যবহারকারীরা এর বেশকিছু সুবিধা ভোগ করেন।
গ্রাহকরা জানিয়েছেন, এতে তারা গ্যাসের ব্যবহারে সাশ্রয়ী হয়েছেন, গ্যাসের অপচয় রোধ করতে পারছেন। বিলও ৪০ ভাগ কম আসছে।
এতো সুবিধা থাকার কারণে অনেক গ্রাহক মিটার বসাতে আগ্রহী হলেও বসাতে পারছে না।
গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর জন্য মিটারের চাইতে চুলা প্রতি অর্থ পরিশোধ বেশি লাভজনক হওয়ায় এ কার্যক্রমে এতো ধীরগতির বলে অভিযোগ করে গ্রাহকরা।
মিরপুরের বাসিন্দা জাহানারা বেগম জানান, প্রিপেইড মিটার বসানোর আগে চুলাপ্রতি বেশি বিল আসতো। কিন্তু তার মায়ের বাড়িতে প্রিপেইড মিটারের জন্য আবেদন করেও মিটার পাচ্ছেন না তিনি।
তিনি বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়ানোর গতি বাড়ে। কিন্তু এর লস ঠেকাতে উদ্যোগ নেয়ার গতি বাড়ে না। কারণ এতে গ্রাহকদের সুবিধা।’
সূত্র : বিবিসি