আদালতে খালেদা জিয়া
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘মাননীয় আদালত, একটি বেসরকারি সংস্থা হিসেবে গত সাত বছরে ব্যাংক থেকে চুরি হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী ব্যাংক লুটের হাজার হাজার কোটি টাকাকে ‘সামান্য’ বলে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. আখতারুজ্জামানের আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে তৃতীয় দিনের মতো দেওয়া বক্তব্যে এসব কথা বলেন খালেদা জিয়া। আদালতে প্রায় দেড় ঘণ্টা বক্তব্য দেন সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী।
খালেদা জিয়া বলেন, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে দায়মুক্তি দিয়ে সীমাহীন দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির প্রমাণিত অভিযোগের সাজা সুপ্রিম কোর্টে বহাল থাকা ব্যক্তিরও মন্ত্রিসভা ও সংসদে সদস্যপদে বহাল থাকছে। জনগণের অর্থ এবং জনস্বার্থের তোয়াক্কা না করে পচা গম আমদানির জন্য দায়ী লোকও বহাল তবিয়তে মন্ত্রিত্ব করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নামে আইটি খাতে বিশাল দুর্নীতি চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রিজার্ভের অর্থ থেকে ৮০০ কোটি টাকা কারসাজি করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন তাঁর বক্তব্যে আরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সম্পন্ন বিচারের নথিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রবাসীপুত্রের সন্দেহভাজন একটি অ্যাকাউন্টেই প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থের কথা এসেছে। সে ব্যাপারে কোনো উচ্যবাচ্য না করে অপ্রমাণিত অভিযোগে মামলা করে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও হেনস্তা করা হয়েছে। অপপ্রচার করা হয়েছে বিএনপির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের গরিব মানুষের অর্থ চুষে সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্টগুলোতে জমানো টাকার স্তূপ ফুলে ফেঁপে উঠছে।’
খালেদা জিয়া বলেন, “২০১৫ সালে শুধু এক বছরেই এসব অ্যাকাউন্টে বেড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। গত ১০ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতায় নেই। এই ১০ বছরে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘জিএফআই’-এর হিসাবে দেশ থেকে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার হয়েছে। ফাঁস হওয়া পানামা পেপার্সে বিদেশে অবৈধ পথে ক্ষমতাসীনদের পাচার করা বিপুল অর্থের খবর প্রকাশিত হয়েছে।”
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘অফসোর কোম্পানিগুলোতে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই কেলেংকারি নিয়ে দুদক একটি মামলাও দায়ের করেনি। দেশে এখন কোনো খাতই অবাধ লুটপাট থেকে মুক্ত নয়। অথচ এখনো প্রচারণা ও মামলা চলছে আমাদের বিরুদ্ধে। দেশের সম্পদ লুট করে কারা? আর মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হয় কাদের? অপপ্রচার চলে কাদের বিরুদ্ধে? আমাদের বিরুদ্ধে তো কম অপপ্রচার করা হয়নি।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘সারা দুনিয়া চষে বেড়িয়ে এবং সব তন্নতন্ন করে দেখে কয় লাখ বা কয় কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আজ পর্যন্ত আনতে পেরেছে? অথচ তাদের বিরুদ্ধে এক-একটি ঘটনাতেই শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ আজ সবার মুখে মুখে।
মাননীয় আদালত, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষরা কখনো সহ্য করতে পারে না। সে কারণেই শহীদ জিয়ার নাম ও তাঁর স্মৃতি বিজড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করে ধ্বংসের চেষ্টা চলছে। শহীদ জিয়ার আদর্শের উত্তরাধিকারী হিসাবে আমাকে এবং আমার পরিবারের সদস্যদের হেয় ও হেনস্তা করার অব্যাহত চেষ্টা সম্পর্কেও সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই যে এ মামলা দায়ের করা হয়েছে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।’
এরপর আদালতে খালেদা জিয়া আজকের মতো বক্তব্য শেষ করলে আদালত আগামী ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক হারুন-অর-রশিদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন—খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী (পলাতক), হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুদক।
২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক হারুন আর রশিদ। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়।
মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন—মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।
সুত্র : এন টিভি