sliderকৃষকশিরোনাম

কৃষি খাতের শ্রমিকদের দুরাবস্থার অবসানকল্পে পদক্ষেপ জরুরি : শেখ নাসির উদ্দিন

১লা মে, মহান মে দিবস। শ্রমিকশ্রেণির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দিন। পৃথিবীর প্রায় শতাধিক দেশে মে দিবস পালিত হয়, এই দিন এসব দেশে সরকারি ছুটি থাকে। শ্রমিক-অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার্থে এই দিনে পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়। মে দিবসের সঙ্গে জড়িয়ে শ্রমিকবিপ্লবের এক মহান ইতিহাস। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে সূচনা হয় এই বিপ্লবের। শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে সেইদনি রাস্তায় নেমেছিলেন। সারা পৃথিবীতে সেইসব শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়ে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি বাস্তবে না হলেও কাগজেপত্রে অর্জিত হয়েছে। অত্যন্ত দুখের বিষয় বাংলাদেশে এই অধিকার প্রকৃত শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে আজও প্রতিষ্ঠা হয়নি। এখানে বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করে চলেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা কোনো ওভারটাইম পায় না। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা যদিও তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় আন্দোলন সংগ্রাম করে চলেছে। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা তাও করতে পারছে না। অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা ১০ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করছে। গায়ের রক্ত পানি করে তারা মালিকদের কাছে শ্রম বিক্রি করে চলছে। কিন্তু ন্যায় পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক জায়গায় তারা প্রতিনিয়ত লাঞ্চনা-বঞ্চনার শিকারও হচ্ছে। দেশের গৃহশ্রমিকরা প্রায়ই খুনের শিকার হচ্ছে। নারী শ্রমিকরা হচ্ছে যৌনহয়রানির শিকার। কিন্তু তার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না। অন্যদিকে কৃষিশ্রমিক, ক্ষেতমজুর, ভূমিহীন মজুর যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক হিসেবে দিন-রাত মালিকপক্ষের বঞ্চনার শিকার হয়ে কাজ করে যাচ্ছে তাদের অবস্থা খুবই গুরুতর।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনীতির স্বার্থে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম করছে। সভা- সেমিনারে কথা বলছে। কিন্তু শ্রমিকদের পক্ষে তেমন কোনো কথা বলছি না। শ্রমিকদের দিয়ে তাদের দলের অঙ্গসংঠন করে মূলত তারা রাজনৈতিক ফয়দা লুটছে। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির কোনো উপকারে আসছে। দেশের প্রধান প্রধান দলগুলো বিগত ৫৪ বছরে পালাবদল করে বহুদিন করে ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু শ্রমিকদের স্বার্থে শ্রমিকদের জন্য কাজ করেছে এমন কোনো দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ নেই। আর এভাবে চলতে পারে না। তাই শ্রমিকশ্রেণিকে আমি বলবো আপনারা একত্রিত হয়ে শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতক দল গঠন করুন। কথিত রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুরভিত্তি ত্যাগ করুন। শ্রমিকশ্রেণি একত্রিত হলে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় শ্রমিকরাই অধিষ্ঠিত হবে। প্রয়োজন শুধু ঐক্যবদ্ধ হওয়া। যতদিন শ্রমিকশ্রেণি এক্যবদ্ধ হতে না পারবে ততদিন শ্রমিকশ্রেণির ভাগ্যোন্নয়নের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই সময় এসেছে শ্রমিকশ্রেণিকে একাতাবন্ধ হয়ে শ্রমিক তথা দেশ ও জাতির জন্য কাজ করার।

শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেয় না মালিকারা। যদিও কিছু কারখানাতে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ তা প্রকৃত শ্রমিকরা করতে পারে না। মালিকপক্ষ তাদের ভাড়াটে শ্রমিকদের দ্বারা নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠানে একটি শ্রমিক সংগঠন দাঁড় করিয়ে নেয়। মালিকের পা-চাটা এই শ্রমিকরাই আজ শ্রমিকশ্রেণির বড় শত্রু। তাই প্রকৃত শ্রমিকদের একতাবন্ধ হয়ে এসব দালালদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মালিক সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় শ্রমিক সংগঠন গঠন করা হলে তা সর্বস্তরের শ্রমিকশ্রেণির কোনো উপারে আসবে না। আমরা বিগত ৫৪ বছর যাবত তাই দেখে আসছি। তাই নিজেদের নেতা নিজেদের বানাতে হবে। নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের কাজ করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল শ্রমিকদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে দেবে না।

দেশের বেশিরভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা নেই। নারী শ্রমিকরা তো আরো বেশি অবহেলিত। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস, বস্তিতে আগুন লেগে প্রতিনিয়ত শ্রমিকশ্রেণির মানুষ জীবন দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য শিল্পমালিকরা তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। বিগত ৫৪ যাবত ক্ষমতায় এসেছে তারা মালিকপক্ষেরই লোক। মালিকপক্ষের শ্রেণিরই লোক। তারা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য মূলত কোনো কাজ করে নাই। বিভিন্ন সেক্টরে আগুনে পুড়ে আহত-নিহত শ্রমিকদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে না। দোষিব্যক্তিরা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোয়ার বাইরে। কোথাও যদি কেউ ধরা পরে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বেরিয়ে যাচ্ছে। তারা সাজা পাচ্ছে না।

প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি শ্রমিক, গৃহশ্রমিকসহ সর্বস্তরের শ্রমিকশ্রেণিকে একাতাবদ্ধ হয়ে নিজেদের অধিকার নিজেদের লড়াই-সংগ্রাম করে অর্জন করে নিতে হবে। তাই ২০২৫ সালের শ্রমিক দিবসে চলুন আমরা শপথ করি—সকল শ্রমিক একত্রিত হয়ে, এক পাতাকলে সমবেত হয়ে আমাদের শ্রমিকশ্রেণির পক্ষের রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলি। শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বেগবান হোক। শ্রমিকশ্রেণির প্রতিষ্ঠা পাক এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আজ এখানেই শেষ করছি।

কৃষি শ্রমিকদের অবস্থা আরো বেশি শোচনীয়। সারাদেশে বিভিন্নভাবে হাওর, বাওড়, খেত-খামারে ঝড়বৃষ্টি-বজ্রপাতে প্রতি বছরে অনেক কৃষক মারা যায়। এছাড়াও কৃষি জমিতে কাজ করতে করতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান অনেকেই। দেশের প্রায় ৭০-৮০ ভাগ মানুষ বিভিন্ন ভাবে কৃষি কাজে যুক্ত হলেও এ খাতের উন্নয়ন তথা শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নে কোন সরকারকেই কৃষিবান্ধব পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সারা বছর রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে যারা আমাদের মুখে অন্ন জোগায় একটা সময় তারাই না খেয়ে মরে। তাদেরকে সরকারি বা বেসরকারি ভাবে কোন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। বিপ্লবী এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে তারা এই মহান মে দিবসে কৃষি খাতসহ সকল খাতের শ্রমিকদের কল্যাণে বাস্তবসম্মত দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button