ভারতের দুই রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্ট হয়ে গেছে। মহারাষ্ট্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে। ঝাড়খণ্ডে অবশ্য ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ও কংগ্রেসের জোটই আবার ক্ষমতায় ফিরছে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটের যা ফলাফল পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ২৮৮টি আসনের মধ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছে ২৩১টি আসন আর শিবসেনা (উদ্ভব ঠাকরে)-এনসিপি-কংগ্রেসের জোট পেয়েছে ৪৯টি আসন।
মে মাসে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে বিরোধী জোট মহা বিকাশ আঘাদি মহারাষ্ট্রের মোট ৪৮টি আসনের মধ্যে ৩০টি আসন জিতেছিল। মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই চিত্রটা সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে গেল।
অন্যদিকে ঝাড়খণ্ডের ৮১ আসনের বিধানসভায় ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা-কংগ্রেস জোট পেয়েছে ৫৬টি এবং বিজেপি জোট পেয়েছে ২৪টি আসন।
কেরালার ওয়েনাডের সংসদ সদস্য হিসেবে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী পদত্যাগ করার পরে সেখানেও উপনির্বাচন হয়েছিল। ওই ভোটে প্রার্থী হয়েছিলেন রাহুলরই বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।
নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী সথ্যান মোকেরিকে চার লাখ ১০ হাজারেরও বেশি ভোটে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। এই প্রথমবার তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন।
মহারাষ্ট্রে বিপুল ভোটে দলের জয়ের পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সন্ধ্যায় এক্স হ্যাণ্ডেলে লিখেছেন ‘উন্নয়নের জয় হয়েছে, সুশাসনের জয় হয়েছে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা আরো উচ্চতায় পৌঁছব। আমি মহারাষ্ট্রের ভাই-বোনেদের, বিশেষ করে রাজ্যের যুব ও মহিলাদের, যারা এনডিএ-কে ঐতিহাসিক জনাদেশ দিয়েছেন, তাদের অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাই।’
আবার ঝাড়খণ্ডের পরাজয় নিয়ে মোদির মন্তব্য : ‘ঝাড়খণ্ডের মানুষকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের পাশে থাকার জন্য। জনসাধারণের সমস্যা উত্থাপন এবং রাজ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা সবসময়ে এগিয়ে আসব। রাজ্যে ভাল ফলাফলের জন্য জেএমএম-এর নেতৃত্বাধীন জোটকে শুভেচ্ছা জানাই।’
ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেন প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দনের পরে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমি শুনেছি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’
এই মন্তব্যে হেমন্ত সরেন প্রধানমন্ত্রীকে কিছুটা ব্যঙ্গ করেছেন বলেই মনে হচ্ছে, কারণ ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীকে প্রায় পাঁচ মাস জেলে থাকতে হয়েছিল একটি জমি কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হিসাবে।
হেমন্ত সরেনসহ ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা-কংগ্রেস জোট এই নির্বাচনের গোটা সময়েই এটা প্রচার করে গেছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তেই কেন্দ্রীয় তদন্ত এজেন্সি দিয়ে হেমন্ত সরেনকে গ্রেফতার করানো হয়েছিল।
‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ প্রচার ব্যর্থ?
এবারের ঝাড়খণ্ড নির্বাচনে বিজেপির প্রচারের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছিল ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ’ ইস্যুটি।
ভোট ঘোষণার আগে থেকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং নির্বাচনি সভাগুলোতে প্রধানমন্ত্রী নিজেও বারবার বলেছেন যে বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরা ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের জমি দখল করে নিচ্ছে।
ওই রাজ্যে ভোটের প্রধান কৌশলী হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছিল আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে। তিনি নিজের রাজ্যেও বারবার বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের ইস্যু তুলে থাকেন।
নির্বাচনের প্রচার-চলাকালীন বিবিসির সংবাদদাতারা ওই রাজ্যে গিয়ে দেখেছিলেন যে বিজেপি এই ইস্যুটিকেই প্রধান করে তুলেছিল যাতে হিন্দু ভোট একজোট হয় আবার আদিবাসীদের যে ভোট বিজেপি হারিয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে, তারও কিছুটা অংশ ফিরে আসে।
তবে সরেজমিন তদন্ত করেও বিবিসির সংবাদদাতারা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরা জায়গা-জমি দখল করে নিচ্ছে অথবা আদিবাসী নারীদের বিয়ে করে নিচ্ছে, বিজেপির তোলা এইসব প্রচারণার কোনো ভিত্তি খুঁজে পাননি।
মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেন মাত্র একবার বিষয়টা নিয়ে মুখ খুলেছিলেন এবং সেখানেও বিজেপিকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন যে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের কথা বলা হচ্ছে, তাহলে কী করে সেদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেয়া হয়েছে, কি করে তার বিমান ভারতের মাটিতে নামার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তাহলে কী বাংলাদেশের সাথে আসলে বিজেপিরই কোনো গোপন বোঝাপড়া আছে, প্রশ্ন তুলেছিলেন সরেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ যে আদৌ বিজেপির পক্ষে কাজ করেনি, তা ভোটের ফলেই বোঝা যাচ্ছে।
মহারাষ্ট্রে পাঁচ মাসেই ছবি বদল
লোকসভা ভোটের ফলাফল দেখে অনুমান করা হচ্ছিল, বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ও তার নেতৃত্বাধীন ‘মহায়ুতি’ জোটকে বড়সড় ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
কিন্তু ভোটের ফল বের হওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে যে হয়েছে তার বিপরীত।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট তো বিপুল সংখ্যক আসন নিয়ে জিতেইছে, তাছাড়া বিজেপি একাই রাজ্যের বৃহত্তম দল হিসাবে উঠে এসেছে। ইতোমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে যে সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীর পদটা তাদের থেকেই কেউ হবেন।
কিন্তু গত পাঁচ মাসে এমন কী হলো যাতে বিজেপির ফলাফল পুরোপুরি ঘুরে গেল?
বিবিসি মারাঠি বিভাগের সম্পাদক অভিজিৎ কাম্বলে বলছিলেন, ‘এবার বিজেপি নেতৃত্বাধীন ‘মহায়ুতি’ জোট লোকসভা নির্বাচনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে।’
তার কথায়, ‘রাজ্যে ‘মহায়ুতি’ জোট অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি ভোটারদের নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করেছিল।
উত্তর মহারাষ্ট্রে, যেখানে সবথেকে বেশি পেঁয়াজ চাষ হয়, সেখানে কৃষকরা পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। সরকার তাদের জন্য স্পষ্ট নীতি ঘোষণা করেছে।
গতবার বিজেপি তার ভোটার এবং দলীয় কর্মীদের এটা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিল যে জোটসঙ্গী অজিত পাওয়ারের এনসিপি দলকে ভোট কেন দেয়া দরকার। তবে লোকসভা ভোটে পরাজয়ের পরেই বিজেপি এটা নিয়ে মাঠে নেমে গিয়েছিল। তাছাড়া স্থানীয় নানা ইস্যুকেও তারা তুলে ধরেছিল।’
খেলা ঘুরিয়ে দিলো যে প্রকল্প
অভিজিৎ কাম্বলে বলছেন যে ‘লাডলি বহিন যোজনা’ প্রকল্পটি এক কথায় ‘গেম চেঞ্জার’ বা খেলা ঘুরিয়ে দেয়ার কাজ করেছে।
ওই প্রকল্পের অধীনে প্রতি মাসে নারীরা ১ হাজার ৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন। যেসব পরিবারের বার্ষিক আয় আড়াই লাখ টাকার কম, সেরকম পরিবারের ২১ থেকে ৬০ বছর বয়সী নারীরা এই প্রকল্পের সুবিধা পান।
মুম্বইয়ের প্রবীণ সাংবাদিক সমর খাদাস বলছেন যে বিধানসভা ভোটের এই ফলাফল আসলে ক্ষমতাসীন ‘মহায়ুতি’ সরকারের কৌশলের জন্য হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘লাডলি বহিন যোজনা, হিন্দুত্ব ও বিভিন্ন জাতের ভোটারদের ঐক্যবদ্ধ করার কৌশলই বিজেপিকে এই সাফল্য এনে দিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের পরেই ‘লাডলি বহিন যোজনা’ চালু করা হয়, যাতে আড়াই কোটি নারীর অ্যাকাউন্টে চার মাসের টাকা একসাথে চলে আসে। এর পাশাপাশি ‘বাটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’ যে স্লোগান তুলেছিল তারা, তার ফলে হিন্দু ভোট কিছুটা হলেও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কংগ্রেস যখন লোকসভা নির্বাচনে জিতেছিল, তখন মারাঠা সংরক্ষণের বিষয়টি চলছিল, তখন মারাঠারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। আবার এই ভোটের সময় বিজেপির কয়েকজন নেতা সংবিধান বদলের কথা বলেছিলেন।’
‘এর প্রভাব পড়েছে এখানকার বৌদ্ধ ও দলিত ভোটে। প্রায় নয় থেকে ১০ শতাংশ বৌদ্ধ ভোট বিরোধী ‘মহা বিকাশ আঘাদি’র দিকে গিয়েছে। মারাঠা-দলিত ভোট সুসংহত করার পাশাপাশি মুসলিমদের ভোটও বেড়েছে।’
বিরোধীরা কেন ব্যর্থ হলো?
মহারাষ্ট্র নির্বাচনে বিরোধী ‘মহা বিকাশ আঘাদি’ জোটে ১০১টি আসনে লড়েছিল কংগ্রেস।
লোকসভা ভোটের ফলের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে বিধানসভায় বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসবে বলে তারা আশা করেছিল।
কিন্তু ফলাফল বের হওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে বিরোধী জোটের রথী মহারথীরাও পরাজিত।
কোথায় ভুল ছিল তাদের?
বিশ্লেষক সমর খাদাস বলেন, ‘মহায়ুতি সরকার যখন ১ হাজার ৫০০ টাকার লাডলি বহিন প্রকল্প এনেছিল, তখন মহা বিকাশ আঘাদি তার সমালোচনা করেছিল। তারপর মহা বিকাশ আঘাদি নিজেই তাদের নির্বাচনি ইস্তেহারে তিন হাজার টাকা দেয়ার একটা প্রকল্পের কথা বলে।’
সমর খাদাস বলেন, মহা বিকাশ আঘাদির দলগুলি ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করেছে বলে মনে হয় না। কংগ্রেসের ভুল ধারণা ছিল যে আমাদের জনভিত্তি দেখা হলে আরও বেশি আসন পাওয়া উচিত। এর ফলে কংগ্রেস-শিবসেনায় মতানৈক্য দেখা দেয়। অন্যদিকে রাহুল গান্ধী আদানি, ধারাভি বস্তি এবং মুদ্রাস্ফীতির মতো ‘নন-ইস্যু’তে মন দিয়েছিলেন।’
হিন্দুত্ববাদী কার্ড কতটা কাজ করেছে?
মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের সময় ‘বান্টেগে তো কাটেঙ্গে’, অর্থাৎ ভাগ হলেই আক্রমণ আসবে এই স্লোগানটি খুব শোনা গেছে। একই সাথে ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’, অর্থাৎ এক থাকলেই সুরক্ষিত থাকবেন-এই স্লোগান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে। এই দুটি স্লোগানই ছিল হিন্দুদের উদ্দেশ্য করে দেয়া, যাতে হিন্দু ভোট একজোট হয়ে যায়।
তবে বিশ্লেষক সমর খাদাস বলছেন যে এটা হিন্দুত্বের বা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জয় না। এটা রাজনৈতিক কৌশলের জিত।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কৌশলগতভাবে লড়া হয়। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তো বিজেপি সারা দেশেই করছে। আরএসএস ও বিজেপি তো সেটা করবেই। কিন্তু কংগ্রেস কী কখনো তার পাল্টা আখ্যান তৈরি করতে পেরেছে? তারা তো পাল্টা বক্তব্য রাখেনি!’
তবে এটাও ঘটনা যে মহারাষ্ট্র বিধানসভার নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নীতিসমূহ এবং তার জনপ্রিয়তাকেও বিজেপি ভালই ব্যবহার করেছে।
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল খারাপ হওয়ার পরে মোদি দলের ভেতরে একটু নড়বড়ে হয়ে পড়েছিলেন বলে অনেকে মন্তব্য করছিলেন, কিন্তু মহারাষ্ট্রে জয়ের পরে দলের অন্দরে মোদির অবস্থা আরো পাকাপোক্ত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি