করোনায় আতঙ্কিত নগরবাসীকে শুধু নিরাপত্তা কিংবা সচেতনতা নয়; জনহিতকর কাজ ও মানবিক সহায়তা করে সারাদেশে নজর কেড়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।
নগরীতে এপ্রিল মাসের শুরুতেই প্রথম ১০ দিনে ৫০ হাজার খেঁটে খাওয়া মানুষের বাসায় খাদ্যসামগ্রী পাঠিয়েছে সিএমপি। এরপর এখন আরও হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। জলকামানের মাধ্যমে নগরীতে জীবাণুনাশক ছিটানো, গভীর রাতে প্রসূতিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বাসায় বাজার করে দেয়া, মধ্যবিত্তকে বাসায় গিয়ে খাদ্যসামগ্রী দিয়ে আসা এবং চিকিৎসকদের বাড়ি ছেড়ে দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে নি¤œবিত্তদের ধান কাটতে হাওড়ে পাঠানোসহ বিভিন্ন মানবিক কাজে যুক্ত হওয়া এখন চট্টগ্রাম নগরে পুলিশ মানে বন্ধু। যে বন্ধু বিপদে পাশে দাঁড়ায়। তাই সেই পুলিশ সদস্যদের অভিবাদন জানিয়েছে নগরবাসী।
গত ২৪ মার্চ থেকে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে জলকামানের মাধ্যমে জীবাণুনাশক পানি ছিটানো শুরু করে পুলিশ। এরপর ১ মার্চ থেকে নগরীর ১৬টি থানায় অসহায় নি¤œবিত্ত দুঃস্থদের বস্তি ও কলোনীতে রাতে গিয়ে খাদ্য সামগ্রী দিয়ে আসে।
এসব কর্মকান্ডের মাঝে গত ১৮ এপ্রিল দেশ রূপান্তরের অনলাইনে ‘বেতন নেই গৃহশিক্ষকদের , ভোগান্তি চরমে’ এই শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর কোতোয়ালী এলাকার প্রায় ৪০টি গৃহশিক্ষকের পরিবারে রাতে গিয়ে খাদ্য সামগ্রী দিয়ে আসে সিএমপি।
কোতোয়ালীর এক বাসিন্দা রুমিতা ইসলাম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘রাতে পুলিশ সদস্যরা মাথায় করে বস্তায় চাল ডাল, আলু পেঁয়াজসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী নিয়ে এসেছিল। দুই মাসের টিউশনের বেতন না পেয়ে বাসায় নিয়মিত রান্না হচ্ছিল না। পুলিশের এমন সহায়তায় এখন ভাত খেতে পারছি। তারা বলেছে আরও প্রয়োজন হলে যোগাযোগ করতে।’
এ বিষয়ে কোতোয়ালী থানার ওসি (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান জানান, টিউশন যারা করে তাদের অনেকে বেতন পায়নি এই সংবাদ দেখার পর তাই আমরা ছুটে গেছি তাদের বাসায় বাসায়। কমিশনার স্যারের নির্দেশ ছিল এই সময়ে মধ্যবিত্তদের বাসায় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানোর। এমনিক কেউ ম্যাসেঞ্জারে নক দিয়ে জানালেও তাদের জন্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছি। কারণ আমাদের পরিবার আছে, আমরা চাই না কেউ অভূক্ত থাকুক।
শুধু খাদ্যসামগ্রী নয় নি¤œবিত্ত এবং উপাজর্নহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের হাওর এলাকায় ধান কাটতে পাঠানোর সিএমপির এমন উদ্যোগে ব্যতিক্রমী নজির স্থাপন করেছে। গত রোববার পাঁচটি বাসে ১০০ শ্রমিককে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলায় হাওড় অঞ্চলে পাঠানো হয়। সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমানের নির্দেশে পুলিশ এ বিষয়ে সার্বিক তত্ত্বাবধান করছে।
এ বিষয়ে সিএমপির উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান বলেন, ‘বাকলিয়ায় বিভিন্ন বস্তি ও কলোনিতে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে ধান কাটায় আগ্রহীদের মধ্যে রবিবার ১০০ জনকে কিশোরগঞ্জের হাওড় অঞ্চলে পাঠিয়েছি। যাতে ধান কাটার কোনো সংকট তৈরি না হয়। সিএমপি কমিশনার মহোদয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের যাবতীয় সুরক্ষা সামগ্রী দিয়েই পাঠিয়েছি’।
তিনি আরও বলেন, সেখানে পৌঁছার পর ওই এলাকার পুলিশ তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন শেষে তারা ধান কাটার কাজে যোগ দেবেন। শ্রমিকদের পরিবহনে এস আলম গ্রুপ বাস দিয়ে সহায়তা করছে। মানবিক পুলিশিং এর সার্বিক বিষয়ে সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলছে। বাংলাদেশও এ সমস্যার মুখোমুখি। সরকার করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ছুটি ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে কর্মহীন হয়ে পড়েছে অনেক শ্রমজীবী মানুষ। তাদের পরিবারে যেন খাদ্যসংকট না হয়, সে জন্যই চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান সহযোগিতায় পুলিশ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি চালু করেছে। এছাড়া ভিড় এড়াতে রাতের বেলায় পুলিশ সদস্যরা ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। যাতে মানুষ ঘর থেকে বের হতে না হয়। কারো কিছুর প্রয়োজন হলে পুলিশকে জানাতে বলেছি’।
গত ৭ এপ্রিল মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার সময় কোতোয়ালীর ওসির মোবাইলে ফোন করে এক লোক তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জন্য গাড়ির সহায়তা চান।
এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘ওই প্রসূতির স্বামী শিপন ফোন করতেই আমাদের থানার টইল গাড়ি পাঠিয়ে দিই। কারণ তখন গভীর রাত, রোগীর অবস্থাও খারাপ ছিল। আমাদের দুইজন সহকর্মী তাদের হাসপাতালে নিয়ে গেছে। প্রসূতির কোলজুড়ে জন্ম দেয় একটি কন্যাসন্তান। মানবিক এসব সহায়তা না করলে মানুষ কার কাছে যাবে এই সময়ে? আমরা মাঠে আছি জনগনের জন্য’।
চট্টগ্রামে পুলিশের চার সদস্য করোনায় আক্রান্ত। তবুও মানবিক পুলিশিং কার্যক্রমে থেমে নেই অন্য সহকর্মীরা। ভয়কে জয় করে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন তারা। পাশপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন অন্যান্য কর্মকান্ড।