sliderমতামতশিরোনাম

কমরেড অমল সেন, তেভাগার লড়াই ও কমিউনিস্ট আন্দোলন : পরিচ্ছেদ-১

বিমল বিশ্বাস

কমরেড বিমল বিশ্বাস :

বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে ‘আইয়ুব শাহী’র শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল ছাত্রসমাজ। সংগঠিত হয় বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন। সেই আন্দোলনে গোবরা গ্রামের ১৪ বছরের কিশোর বিমল বিশ্বাসের প্রথম মিছিলে যাওয়া। শিক্ষা আন্দোলন থেমেছে; কিন্তু বাষট্টি বছর ধরে থামেনি তাঁর মিছিলে মিছিলে পথচলা। ছয় দশকের উর্ধ্বে তিনি মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত থেকেছেন।

মার্কসবাদী নেতা বিমল বিশ্বাসের শিক্ষা জীবন নড়াইলে। তিনি ছিলেন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক, কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতি। ছাত্র জীবনেই কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি দুই ধারায় বিভক্ত হলে তিনি পিকিংপন্থী অংশে ছিলেন। ১৯৭০ সালে সুখেন্দু দস্তিদার-হক-তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বৃহত্তর যশোর জেলা কমিটির সদস্য হন।

১৯৭১ সালে পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বৃহত্তর যশোর জেলায় সাহসী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন বিমল বিশ্বাস। এক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের (একই সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী) বিমল বিশ্বাসের নেতৃত্বে যশোর জেলা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।

১৯৭৪ সালে বিমল বিশ্বাস গ্রেপ্তার হয়ে এক নাগাড়ে সাড়ে পাঁচ বছর বিশেষ ক্ষমতা আইনে বন্দি ছিলেন। শুধু তাই নয় ১৯৭০ সালের মার্চ থেকে পাকিস্তান সরকারের মিথ্যা কেসে সাড়ে পাঁচবছর আত্মগোপনে ছিলেন। ১৯৭৯ সালের নভেম্বরে হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তিলাভের পর কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন। ঐক্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৮২ সালে বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ ১৯৮৭ সালে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ গঠিত হয়। ১৯৯২ সালে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি এবং সাম্যবাদী দল (এম-এল)-র একাংশ একীভূত হয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নামে আত্মপ্রকাশ করে। তিনি ১৭ বছর উল্লেখিত সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেছেন। ৬১ বছর যাবৎ কমিউনিস্ট আন্দোলনে সকল সময়েই সার্বক্ষণিক হিসাবেই যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন বাম পাঁচদল এবং বামফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা।

বিমল বিশ্বাস স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সাহসী সংগঠক। তিনি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের লক্ষ্যে গণআদালত গঠনের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯৮ সালে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে শুরু থেকেই উদ্যোগী ছিলেন ও সক্রিয়ভাবে পুরোভাগে থেকে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছেন। ১৪ দল গঠনের শুরুতেও তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা ও রূপকার। সক্রিয় ছিলেন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের আন্দোলনসহ নানা সামাজিক ও নাগরিক আন্দোলনেও।

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর অনেক বিপ্লবীই পথ হারিয়েছেন, নিপীড়ন বা প্রলোভনে কেউ কেউ আপস করেছেন। কমরেড বিমল বিশ্বাস সংগ্রামের পথে সর্বদাই আপসহীন, নির্ভীক। নীতিতে অটল। এখনও স্বপ্ন দেখেন শোষণমুক্ত বাংলাদেশের, সাম্যবাদী বিশ্বের।

পেছনের কথা :

২০০৪ সালের ১৭ই জানুয়ারী কমরেড অমল সেনের মৃতু্যুর পর প্রথম স্মরণসভা হয়। স্মরণসভাটি হয়েছিল যশোর-নড়াইলের বাকড়ি স্কুলে কমরেড অমল সেনের সমাধির পাশেই। স্মরণসভার পাশে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রকাশনা গণপ্রকাশনের একটি স্টল দেওয়া হয়। মেলায় অংশগ্রহণকারী অনেকেই কমরেড অমল সেন সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই তাঁর জীবনী সম্পর্কে বইলেখার দাবী করেন। বুকস্টলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমরেড অজয় কুমার রায় এসংক্রান্ত ব্যাপারে আমাকে একটি বই লেখার ব্যাপারে বলতে থাকে। ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো তিন ফর্মার মধ্যেই কমরেড অমল সেনের আত্মজীবনী শেষ করবার সিদ্ধান্ত দেয়। দ্রæততার সাথে আমি একটি বই লিখে দিয়েছিলাম। বিলম্বে হলেও কমরেড অমল সেনের আত্মজীবনীমূলক বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। তথ্যগত কোনো ভুল থাকলে তা সংশোধনের জন্য আমার কোনো আপত্তি থাকার কারণ ছিল না। শুনেছি কারো কারো তথ্য সম্পর্কে কিছু আপত্তি ছিল। সততার সাথে আমাকে বললে ভুল হলে তা সংশোধন করবার মন মানসিকতার ঘাটতি আমার থাকার কথা নয়। কিন্তু এবার আমার উপলব্ধি ও বিবেচনায় কমরেড অমল সেন তেভাগার লড়াই ও কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে যতটুকু বিস্তৃত লেখা যায় সেই চেষ্টাই করলাম। মার্কসবাদী আদর্শ, রাজনীতি ও সংগঠন সম্পর্কে যে সকল আগ্রহী পাঠক বইটি পড়বেন তারা উপকৃত হতে পারেন বলে বিশ্বাস করি। তবে আমার এই লেখা ভবিষ্যত প্রজন্ম, ইতিহাসবিদ, গবেষকদের সাহায্য করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এই বইটি লেখার শুরুতে নড়াইলের এস কে রুবেল ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অয়ন রায় শ্রুতিলিখনে সহযোগিতা করে। পরবর্তীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী প্লাবন খালিদ সামগ্রিক ভাবে শ্রুতিলিখনের কাজটি সমাপ্ত করে। আমি কমরেড অমল সেনকে ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগপর্যন্ত যেভাবে দেখেছি, যেভাবে জেনেছি এবং তাঁর মূল্যবান লেখা থেকে যা রপ্ত করার চেষ্টা করেছি সে সম্পর্কে আমার লেখা উচিত বিধায়-আমি কমরেড অমল সেন তেভাগার লড়াই ও কমিউনিস্ট আন্দোলন বইটি লিখলাম। বিষয়বস্তুর দিক থেকে বিবেচনা করলে অনেক বড় বই লেখা যায়। কিন্তু লেখা পড়ার ক্ষেত্রে যে বড় ধরনের অবহেলা ও অন্যমনস্কতা রয়েছে সেকারণে আমাকে অনেকেই যত সংক্ষিপ্ত আকারে পারি সেভাবেই লিখতে বলেছেন। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশের প্রকাশক শ্রী কমল কান্তি দাস বইটি প্রকাশ করার জন্য তাকে বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ।

পরিচ্ছেদ-১

প্রাক কথন :

জন্মেছিলাম নড়াইল সদর থানার গোবরা গ্রামে। আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়তাম তখন গোবরা অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত ১০টি গ্রামেই আমার যাতায়াত ছিল। সেসব গ্রামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খলিশাখালী, নলদীর চর, গোয়াইল বাড়ি, রামনগরের চর, আগদিয়ার চর, আগদিয়া, শিমুলিয়া, বন খলিশাখালী, নিরালী, দেবভোগ, বাহিরগ্রাম, কোড়গ্রাম, মুলিয়া, পানতিথা, আখোদা, টেপারী, তুলারামপুর, একোড়বা, দূর্বাজুড়ী, সিতারামপুর, হিজলডাঙ্গা, বাঁশভিটা, নুনক্ষীর, সাতঘরিয়া, বনগ্রাম, ধোপাখোলা, বড়েন্দার, ছোট মুশুড়িয়া, বড় মুশুড়িয়া, বীড়গ্রাম, উজিরপুর, কলোড়া, এসকল গ্রামগুলি প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত ছিল। হাতেগোনা গোবরা, নলদীর চর, আগদিয়া, শিমুলিয়া, বাহিরগ্রাম, তুলারামপুর এই কয়েকটি গ্রামেই ঐসময়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতো। তাছাড়া অন্যান্য সকল গ্রাম একেবারেই হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত ছিল। তন্মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওই গ্রামগুলোতে নমসূদ্র সম্প্রদায়ই ছিল সর্বাধিক। নমসূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে কোড়গ্রাম, ছোট মুশুড়িয়াসহ হাতেগোনা কয়েকটি গ্রামে শেফালী নমসূদ্ররাই বসবাস করতেন। অন্যান্য হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ধানী নমসূদ্ররাই বসবাস করতেন। কোনো কোনো গ্রামে রাজবংশী (জেলে) সম্প্রদায়ও ছিল। আমি যখনকার কথা বলছি তখন সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিভাজন ছিল প্রকট। জাতপাতের যে বিদ্বেষ দেখেছি সে সম্পর্কে এখানে তেমন আলোচনায় যাচ্ছি না।

আমি নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হলাম তখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ গ্রামে আমার যাতায়াত ছিল না। আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলতে কোড়গ্রাম, মুলিয়া ও পানতিথায়ই ছিল। ছোটবেলায় কোড়গ্রামে মামা বাড়িতে যখন যেতাম তখন পানতিথা গ্রামের আমার মাসি মার বড় পুত্র বিএড শিক্ষক নারায়ন চন্দ্র বর্মণদের বাড়িতে যাওয়া ছাড়া আর কোথাও যাওয়া হতো না। কোড়গ্রাম, মুলিয়া, পানতিথা ওই অঞ্চলে ধুমধামের সাথে কালীপূজা হতো। কালীপূজার পরের দিন মূর্তি ভাসানোকে কেন্দ্র করে ভৈরব নদীর শাখা মুলিয়া গ্রামের পাশে ওই নদীতে কালী প্রতিমা নিয়ে বিসর্জনের জন্য নানা আয়োজনে প্রচণ্ড ভীড় হতো। আমি যে গ্রামগুলোর নাম বলেছি তন্মধ্যে বেশিরভাগ গ্রামই বর্ষাকালে পানিতে ডুবে যেত। নৌকা, ডোঙ্গা ছাড়া যাতায়াতের জন্য তেমন কোনো কাচা রাস্তা ছিল না। আমি নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক তখন এগারোখান বাদে (এগারোটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম) অন্যগ্রাম গুলোতে রাজনৈতিক কারণেই বেশি যাতায়াত ছিল। নড়াইল সদর থানা ও লোহাগড়া থানার প্রায় সকল গ্রামেই তখন গিয়েছি। এগারোখানের এগারোটি গ্রামের ৭টি গ্রাম ছিল নড়াইল থানার অন্তর্ভূক্ত সেগুলো হলো- আখোদা, টেপারী, মালিয়াট, বেনাহাটি, হাতিয়াড়া, গুয়াখোলা, মান্দিয়া। বাকড়ি, দোগাছি, ঘোড়ানাছ, কমলাপুর এই চারটি গ্রাম ছিল বাঘারপাড়া থানার অন্তর্ভূক্ত।

ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে (মেনন গ্রুপ) সংগঠিত করতে উল্লিখিত ঐসকল গ্রামের স্কুল এবং কলেজগুলিতে যেতাম। কিন্তু এগারোখানের ১১টি গ্রামে ১৯৬৭ সালের ১৯শে ডিসেম্বরের আগে কখনো যাইনি। এগারোখানের ১১টি গ্রাম বর্ষাকালে পানিতে একেবারেই ডুবে যেত। নৌকা ও ডোঙ্গার সাহায্যে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে হতো। শীতকালেও কর্দমাক্ত কাঁচা রাস্তায় কোথাও কোথাও যাওয়া যেত।

১৯৬৭ সালের ১৯শে ডিসেম্বর বাকড়ি গ্রামে কমরেড মমতাজ উদ্দীন, সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন ও আমি গিয়েছিলাম। ১০ বছর পর সদ্য কারামুক্ত প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড অমল সেনের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যোগদানের সময়ে কমরেড অমল সেনের সম্পর্কে জানতাম তিনি তেভাগা আন্দোলনের
চলবে/২১

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Back to top button