sliderমতামতশিরোনাম

কমরেড অমল সেন, তেভাগার লড়াই ও কমিউনিস্ট আন্দোলন : পরিচ্ছেদ-২৩

বিমল বিশ্বাস

উপসংহার ও উপলব্ধি :

কমরেড অমল সেন তেভাগার লড়াই ও কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে যখন লেখা শুরু করেছিলাম তখনই আমার উপলব্ধিতে ছিল অত্যন্ত এক কঠিন কাজে হাত দিলাম। বৃটিশ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের শুরু থেকে ৯০এর দশক পর্যন্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনের এহেন গুরুত্বপূর্র্ণ ইস্যু নেই যেসম্পর্কে কমরেড অমল সেনের নিজস্ব ব্যাখ্যামূলক লিখিত মতামত নেই। মার্কসবাদী দর্শন, রাজনীতি ও সংগঠন এবং কমরেড অমল সেনের জীবনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের যে গভীরতা সেখানে পৌঁছানো আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। আমি মার্কসবাদ, লেনিনবাদ সম্পর্কে যেটুকু শিখেছি এবং ৬২ বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকেই কমরেড অমল সেন সম্পর্কে আমার এই লেখার প্রয়াস। অতীত ও বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তিতে মাটির অত্যন্ত গভীর থেকে পাথর উত্তোলনের কাজটিকে এখনো পর্যন্ত আমি কঠিন কাজ হিসাবে মনে করি। তাই কমরেড অমল সেনের ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে যে বিরোধ পরবর্তীকালে জনযুদ্ধের লাইন, কংগ্রেসের অভ্যন্তরে পার্টির কাজ, তেভাগা আন্দোলনের সমীক্ষা, কমরেড রণদীভের লাইন, পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক কৌশল, ভাষা আন্দোলন, গণতন্ত্রী দল গঠন, আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্যে পার্টির কাজ, যুবলীগ গঠন, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা সম্মেলন, ১৯৫৭ সালে ন্যাপ গঠন, ১৯৫৭ সালে ১২ পার্টির সম্মেলন, ১৯৬০ সালে ৮১ পার্টির সম্মেলন, চীন-ভারত যুদ্ধের সময় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভারত সম্পর্কে সম্প্রসারণবাদী দেশ মূল্যায়ন, ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে শান্তিপূর্ণ উত্তরণ, শান্তিপূর্ণ সহযোগিতা, শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের পার্টির লাইন, কমরেড স্টালিন ও কমরেড মাও সেতুং সম্পর্কে মূল্যায়ন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লাইন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯৬৩ সালের ১৪ই জুনের চিঠি ও তার জবাবে ১৯৬৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ১৪ই জুলাইয়ের চিঠি, আমাদের দেশে মস্কো-পিকিং লাইনের অনুসারীদের আদর্শিক রাজনৈতিক বিরোধ ও পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙ্গে যাওয়া ও তার মূল্যায়ন সম্পর্কে কমরেড অমল সেনের মতামত আমার লেখায় সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও উল্লেখ করেছি। কিন্তু এছাড়াও যেসব বিষয়ে কমরেড অমল সেন নিজস্ব মতামত লিখে গেছেন সে সংক্রান্ত ব্যাপারে আমি কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্বার্থেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতাকর্মী শুভানুধ্যায়ীদের পড়তে অনুরোধ করবো। মূল্যায়নের দায়িত্ব যার যার নিজের। মার্কসবাদ বৈজ্ঞানিক ও বিকাশশীল মতবাদ। বিশ্ব যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অধ্যায়ে ঢুকে আছে পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের প্রস্তুতি চলছে তখন মার্কসবাদকে বিশ্ব সা¤্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ কত রকমের মার্কসবাদ বিরোধী মতবাদ দিয়ে বিরোধিতা করবে তার ঠিক নাই সেই সময়ে মার্কসবাদকে উপলব্ধি করার জন্য কমরেড অমল সেনের দৃষ্টিভঙ্গী, চিন্তার পদ্ধতি এবং ব্যাখ্যামূলক লেখাগুলিকে অতীতের বিষয় বলে কেউ কেউ উপেক্ষা করতে পারেন। কিন্তু অতীতের ভুল শিক্ষাকে মাথায় নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঠিক বিষয়ে উপনীত হওয়া যায় না বলেই মনে করি। সেকারণেই অতীতের মতাদর্শগত যেসকল বিরোধ ছিল সেসম্পর্কে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে যত স্বচ্ছ উপলব্ধিতে পৌঁছাতে পারি সেক্ষেত্রে কমরেড অমল সেনের লেখা কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সাহায্য করতে পারে বলে আমার ধারণা। বর্তমানের মধ্যেই ভবিষ্যত নীহিত থাকে একথাও আমরা সকলে জানি। কমরেড অমল সেনের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও জনগণের বিকল্প শক্তি বইয়ের মূল মূল লেখা গুলো সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম-
১. বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্যা প্রসঙ্গে
২. কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শগত বিতর্ক প্রসঙ্গে
৩. নড়াইলে তেভাগা সংগ্রামের সমীক্ষা
৪. জনগণের বিকল্প শক্তি
৫. কমিউনিস্ট জীবন ও আচরণরীতি প্রসঙ্গে।

সর্বশেষ লেখা বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্যা প্রসঙ্গে ।
বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্যা প্রসঙ্গে লেখায় সমাজতন্ত্রের বিজয়ের যুগ ও বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন পন্থী এবং খোঁড়া সাফাই, সমাজতন্ত্র নির্মাণ ও সহযোগিতা, সি.এম.এ.ও. স্বাধীনতার চেতনা, সহযোগিতা বনাম স্বাধীনতার সঠিক সংশ্লেষণ, সমাজতন্ত্র নির্মাণ ও সাহায্য, পার্টি গুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক, মানবিক সম্পর্কের ক্রমবিকাশ, আনুগত্যমূলক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক কেন্দ্র, অন্ধ অনুসরণ ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সমস্যা, কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শগত বিতর্ক প্রসঙ্গে কমরেড অমল সেন লিখেছেন মার্কসবাদ লেনিনবাদ ওয়ার্কার্স পার্টির আদর্শগত ভিত্তি, ভারত উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রসঙ্গে, পূর্ব পাকিস্তান পার্টির প্রথম বিভক্তি, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শগত বিতর্ক প্রসঙ্গে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্র, জাতীয় গণতন্ত্র এবং অধনবাদী বিকাশ, বিপ্লবী উত্তরণের সংগ্রামের ধরণ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, যুদ্ধ শান্তি নিরস্ত্রীকরণ, পারমানবিক অস্ত্র, চীনকে আণবিক অস্ত্রের প্রযুক্তি দিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্বীকৃতি প্রসঙ্গে, সমাজতান্ত্রিক সাহায্য, সমাজতান্ত্রিক শিবিরে আন্তঃসম্পর্ক, গণচীন থেকে সোভিয়েত সাহায্য প্রত্যাহার, কমরেড স্টালিনকে মুছে ফেলার উদ্যোগ, জনগণের রাষ্ট্র এবং জনগণের পার্টি তত্ত¡, ব্রেজনেভের নয়া অর্থনৈতিক সিস্টেম, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ত্রি-বিশ্ব তত্ত¡, সংশোধনবাদী বিচ্যুতি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি, চীনের পার্টি, চেকো¯েøাভাকিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি দেশে ওয়ারশ জোটের হস্তক্ষেপ, বিশ্ব পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক শিবির, আমাদের দেশের আদর্শগত বিচ্যুতির মূল দিকগুলি, বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়া পার্টিতে ঢুকে কমিউনিস্টদের কাজ করা, পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ, ১৯৭১ সালের সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা, ১৯৭১ এর সংগ্রাম এবং সংশ্লিষ্ট বিদেশি রাষ্ট্রসমূহ, ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর হস্তক্ষেপ, নকশাল চিন্তার ভ্রান্তি ও তার আদর্শগত উৎস, বাংলাদেশ ও তার পরবর্তী অধ্যায়, পুতুল সরকার, বাকশাল, মুজিবুর রহমানকে হত্যা প্রসঙ্গে, চক্রান্ত, কমিউনিস্ট ঐক্য প্রসঙ্গে।

জনগণের বিকল্প শক্তি
জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব, পরিবর্তন নয় নেগেশান, সিন্ডিক্যালিজম নয় পার্টি একনায়কত্ব নয়, দুইধরনের বাঁধা-জনগণের নিজেদের মধ্যে বাঁধা ও প্রতিবন্ধকতা, জনগণের নিজেদের মধ্যকার বাঁধাগুলি উৎরাবার পথ একটিই, শোষক রাষ্ট্রের প্রশাসন বনাম জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম, ঐক্য ও সংগঠন আপেক্ষিক, শ্রেণী আন্দোলনের দুই ধারা, শ্রেণী সংগঠনের ঐক্য, শ্রেণী সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন, শ্রেণী সংগ্রাম এবং শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি, ।

কমরেড অমল সেন বুর্জোয়া সরকারে অংশগ্রহণ করা সঠিক নয় বলেছেন। কমরেড অমল সেন জনগণের বিকল্প শক্তি লেখায় তাঁর বইয়ের ১১৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, বুর্জোয়া সরকারে অংশগ্রহণ করা সঠিক নয়। সেব্যাপারে কমরেড অমল সেনের বক্তব্য, “অন্তর্নিহিত বিরোধী দিক (ধংঢ়বপঃ) শক্তিমান করে তুলে ‘নেগেশন’ এই সূত্র ধরে অনেকে বর্তমান সরকারের মধ্যে বিপ্লবীদের ঢুকে পড়ার সুপারিশ করতে পারেন। এক্ষেত্রে মৌলিক ব্যাপারটা খেয়ালে রাখলে এই উৎকট বিভ্রান্তি হয় না। শক্তি আসলে জনগণের। শাসক সরকার সেই শক্তিকে জনগণেরই বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে। এবং এই প্রয়োগ করার সংগঠন হচ্ছে তার সরকার। ডিমের অন্তর্বস্তুটির নেগেশন হয় বলেই খোসাটা আর বহিরাবরণ হিসাবে থাকতে পারে না। খোসাটি ভেঙ্গে ফেললেই ডিমের নেগেশন হয় না। নেগেশনের কাজ খোসার মধ্যে নয়Ñঅন্তর্বস্তুটির মধ্যে। বর্তমান সরকারি ব্যবস্থাপনার শরিক হওয়ার মধ্যে নয়।”

কমিউনিস্ট জীবন ও আচরণরীতি প্রসঙ্গ
অকমিউনিস্ট সমাজের মধ্যে কমিউনিস্ট জীবন, জীবনযাত্রার বৈষম্য, জীবিকা ও পার্টির কাজ, কমিউনিস্ট ও তার পরিবার, ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা, পরিবারের মধ্যকার আচরণ, কমিউনিস্ট ও সন্তান লালন, চাল-চলন, যৌথ সত্তা চেতনা ও ব্যক্তি উদ্যোগ, গণফ্রন্টের কাজ ও পার্টি সংগঠনের কাজ, বিশেষ দায়িত্ব ও যৌথ সত্তা চেতনা, ত্যাগ ও কমিউনিস্ট জীবনবোধ, বামপন্থী কাকে বলেসহ কমরেড অমল সেনের লেখাগুলি যথেষ্ট মাত্রায় ব্যাখ্যামূলক। লেখাগুলো থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে আমার মতামত দিয়ে লিখতে গেলে সেক্ষেত্রে কমরেড অমল সেনের বক্তব্যকে আমি ব্যাখ্যা করতে গেলে যে কেউ ভিন্ন ব্যাখ্যার সুযোগ পেতে পারেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা হিসাবে কমরেড অমল সেন তাঁর লেখার মাধ্যমে রেখে গেছেন গুরুত্বপূর্র্ণ অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা। আমরা কমরেড অমল সেনের কমিউনিস্ট আদর্শবোধ, কমিউনিস্ট জীবনবোধ, সংগ্রাম, আচরণবোধ থেকে অনেক অনেক শিক্ষা পেতে পারি।
শেষ/

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Back to top button