প্রথম পরিচ্ছেদের বাকি অংশের পর-
১৯৬৭ সালের ১৯শে ডিসেম্বর বাকড়ি গ্রামে কমরেড মমতাজ উদ্দীন, সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন ও আমি গিয়েছিলাম। ১০ বছর পর সদ্য কারামুক্ত প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড অমল সেনের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যোগদানের সময়ে কমরেড অমল সেনের সম্পর্কে জানতাম তিনি তেভাগা আন্দোলনের প্রধান সংগঠকদের পুরোভাগে ও নেতৃত্বে ছিলেন। আমরা যখন জানতে পারলাম কমরেড অমল সেন কারামুক্ত হয়ে বাকড়ি গ্রামে এসেছেন তখন শ্রদ্ধাবোধ ও আবেগতাড়িত হয়ে বাকড়িতে গিয়ে কমরেড রসিক ঘোষের বাড়িতে কমরেড অমল সেনের খোঁজ নিলাম। জানতে পারলাম কমরেড অমল সেন বাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে আছেন। আমরা গিয়ে দেখলাম বাকড়ি স্কুলের দুটি বড় বট পাকড় গাছের তলায় বেঞ্চ পেতে বসে আছেন। আমরা গিয়ে আমাদের পরিচয় দিলাম এবং কমরেড অমল সেনের শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিলাম। দীর্ঘ কারাজীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ ব্যক্ত করে সময়ও চেয়েছিলাম।
কমরেড অমল সেনের সঙ্গে যখন আমরা কথা বলছিলাম তখন বাকড়ি স্কুলের শিক্ষক এবং ওই অঞ্চলের সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত কমরেড গোকুল বিশ্বাস আসলেন। একটু অবাকই লাগলো কমরেড অমল সেন বসে আছেন তাঁর সাথে দেখা সাক্ষাৎ কথা বলার কোনো আগ্রহী লোকজনকে সেদিন দেখি নাই। ওই যে এগারোখান গেলাম পরবর্তীতে ছাত্র আন্দোলনের সাথে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নড়াইলে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মকাÐের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ১৯৬৮ সালে খুলনা সুন্দরবন ল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমি যখন খুলনায় চলে যেতে চাইলাম তখন পার্টি আমাকে নড়াইলে থেকেই ছাত্র সংগঠন ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপারে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার জন্য বলে। ফলে আমি ১৯৬৩ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭০ সালের মার্চ পর্যন্ত নড়াইলেই ছিলাম। নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ ও নড়াইল সদর, লোহাগড়া থানার প্রতিটি স্কুলের সাথে ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ঐসময়ে আমরা সর্বাধিক চেষ্টা করেছি।
প্রথম যেদিন এগারোখান গিয়েছিলাম তারপর যতদিন ছাত্র সংগঠন ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম সেসময়ে এগারোখানের বিভিন্ন গ্রামের যেসকল ছাত্র এবং ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের সাথে বিভিন্ন মাত্রায় যুক্ত ছিলাম তাদের নাম যথাক্রমেÑ বাকলী গ্রামের রনজিৎ দত্ত, বলাই দত্ত, বিমল অধিকারী, সরজিৎ গোস্বামী, বরুন রায়। দোগাছি গ্রামের নির্মল ভৌমিক, অজিৎ বিশ্বাস, দুলাল বিশ্বাস, প্রসেনজিত সরকার, অশ্বীনি দাশ। বাকড়ি গ্রামের অসীম রায়, সসীম রায়, গৌরাঙ্গ রায়, অরবিন্দু বিশ্বাস, প্রদ্যুত সরকার, রনজিৎ বিশ্বাস, বলাই ঘোষ। বেনাহাটি গ্রামের অরবিন্দু বিশ্বাস, অঘোর দাম, জগবন্ধু দাম। হাতিয়ারা গ্রামের সুভাস সরকার, কালিপদ সরকার। মান্দিয়া গ্রামের প্রভাষ পাল, সুশান্ত সেন, নির্মল সেন, চিত্তরঞ্জন সেন। কমলাপুরের নিশিকান্ত গোলদার, অনিল গুপ্ত ও মালিয়াটের বিনয় ঘটকসহ আরও অনেকেই ছিলেন।
১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ সালের মার্চ পর্যন্ত যাদের সাথে বিভিন্ন ভাবে সম্পর্কিত ছিলাম এবং ৭৭ বছর বয়সে যাদের নাম আমার মনে আছে তাদের নামই উল্লেখ করলাম। ছাত্র আন্দোলনের সময়কালে এগারোখানের যেসকল ছাত্রদের সাথে আমার পরিচয় ছিল তাদের সম্পর্কে যতটুকু বলা প্রয়োজন তা হয়তো সব হলো না।
তার আগে যেতে না পারার অন্যতম প্রধান কারন ছিল ওই অঞ্চলটিতে নৌকা ও ডোঙা ছাড়া যাবার কোনো সুযোগ ছিল না। আর আমিও নৌকা ডোঙ্গা চালাবার ব্যাপারে ১৯৭০ সালের আগপর্যন্ত ছিলাম আনাড়ি। কিন্তু ওই অঞ্চলের ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত যারা ছিলেন তারা নিজেরাই সংগঠন গড়ে তোলার কাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করত। পরবর্তীতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ছাত্রজীবনে বহুবার গিয়েছি। ছাত্র সংগঠন করলেও কৃষক সংগঠনের কাজ আমাদেরকে করতে হতো। তেভাগা আন্দোলনের ঘাঁটি এগারোখানে আমি যখন গিয়েছি তখন ওই সময়ে কমরেড রসিকলাল ঘোষ, কমরেড প্রভাত শিকদার, কমরেড গোকুল বিশ্বাস, কমরেড বনচারী মজুমদার, কমরেড সন্তোষ মজুমদার, কমরেড নীরোদ লস্কর, কমরেড ভূষণ রায়, কমরেড চুনিলাল গোলদার এবং কমরেড রসিকলাল ঘোষের সাথে ২০ বছর সাঁজাপ্রাপ্ত রঘুবীর রায়ের নামটাও শুনেছিলাম। এঁদেরকেই পেয়েছিলাম এবং এঁদেরই সহযোগিতা পেতাম। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙ্গে সাম্প্রদায়িক কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে ও ১৯৪৮ সালে কৃষক আন্দোলনের নেতা কর্মীদের ওপর আক্রমণ নেমে এলে তেভাগা আন্দোলনের সংগঠকদের উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতবর্ষে চলে যান। শুধু তাই নয়, কমরেড অমল সেন, কমরেড রসিক ঘোষসহ অনেকে কারারুদ্ধ হন। হাতিয়াড়ার শ্যামা কামার, তৎকালীন পার্টি কর্তৃক নিহত হলে নির্যাতনের স্টিম রোলার নেমে আসে। ফলে ওই অঞ্চলে জনমনে ও আন্দোলনের সংগঠকদের মধ্যে এক বিভীষিকাময় ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। কৃষক আন্দোলনের দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে নতুনভাবে কৃষক সংগঠনকে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে। আমি এখন কমরেড অমল সেনের নেতৃত্বে কিভাবে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক আন্দোলনের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল সে আলোচনা শুরু করবো।
পরিচ্ছেদ-২
কমরেড অমল সেনের বাল্য ও কৈশোর জীবন :
নড়াইল মহকুমা (অধুনা নড়াইল জেলা) তে ৪টি জমিদার পরিবার ছিল। তন্মধ্যে পদ্মার এপারে সবচেয়ে বড় জমিদার ছিলেন নড়াইলের রতন রায়। হাটবাড়িয়ার জমিদার ছিলেন জিতেন রায়। কলোড়ার জমিদার ছিলেন নলিনী মিত্র, বিনয় মিত্র, (পশ্চিম বাংলার) কংগ্রেস নেতা প্রয়াত সৌমেন মিত্রদের পরিবার। অন্য জমিদার পরিবারটি হল কমরেড অমল সেনদের আফরার জমিদার পরিবার। অবিভক্ত বাংলায় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও কয়েকটি মুসলিম জমিদার পরিবার ছিল। নড়াইলের জমিদার পরিবারগুলোই ছিল কায়স্থ সম্প্রদায়ের। ওই সময়ে জমিদারদের জমিদারির আভিজাত্য ও সম্প্রদায় আভিজাত্য এমন পর্যায়ে ছিল- একদিকে জমিকেন্দ্রিক শোষণ, খাজনা-ট্যাক্স ও আবায়ব করের শোষণে কৃষকদের সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হতে হতো, অন্যদিকে জমিদার ও সম্প্রদায় আভিজাত্যের মালিকদের সৃষ্ট নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর লোকজনদের জমিদারদের বাড়ির পাশ দিয়ে জুতা পায়ে, ছাতা মাথায় দিয়ে যাওয়ার অধিকার ছিলনা। কমরেড অমল সেন এই ধরনের জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহন করেও দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণায় ভারত বর্ষকে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত করবার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবীদের অনুশীলন দলের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন সময়ে। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন আউড়িয়া গ্রামে তাঁর মামাবাড়িতে। আউড়িয়া গ্রামের প্রসিদ্ধ প্রভাবশালি রায় পরিবার ছিল কমরেড অমল সেনের মামাবাড়ি। রায় পরিবারেরই হরিপদ রায় ছিলেন অনুশীলন দলের নেতা। কমরেড অমল সেন ও তাঁর মামাতো ভাই সন্তোষ রায় একই সাথে অনুশীলন দলের সাথে যুক্ত হন। ১৯৩০ সালে বসুন্দিয়া স্কুল থেকে কমরেড অমল সেন এন্ট্রান্স (এস এস সি) পাশ করেন। জন্মেছিলেন ১৯১৪ সালের ১৯শে জুলাই। বসুন্দিয়া স্কুলে ভর্তি হবার সময়কালে কমরেড অমল সেনের জ্যাঠামশাই চেয়েছিলেন কমরেড অমল সেনকে খুলনা বিকে স্কুলে তাঁকে ভর্তি করতে। কিন্তু বসুন্দিয়া স্কুলের শিক্ষকদের একধরনের চাপে শেষপর্যন্ত বসুন্দিয়া স্কুলে ভর্তি হন। কমরেড অমল সেন একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। ওই সময়ে খুলনার খ্যাতনামা ফুটবলার ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা ও আইয়ুব সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী খান-এ-সবুর। শক্তিশালী খুলনা টিমের সাথে বসুন্দিয়া টিম ড্র করার কারণে বসুন্দিয়াবাসী এটাকেই বিজয় মনে করেছিল। খেলার দিন কমরেড অমল সেনের নামে ছিল গ্রেফতারী পরোয়ানা। তাই বিলম্বে মাঠে নেমেছিলেন এবং খেলা শেষ হওয়ার কিছু আগেই মাঠ ত্যাগ করে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। একদিকে কমরেড অমল সেন ভালো ছাত্র ও ভালো ফুটবলার ছিলেন। এন্ট্রান্স পাস করার পর কমরেড অমল সেন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করার পর খুলনা দৌলতপুর কলেজে গণিতশাস্ত্রে অনার্সে ভর্তি হন। দৌলতপুর কলেজে পড়াকালীন সময়েই কমরেড অমল সেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা যশোর এক কাঠামোর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত হন। ১৯৩৩ সালে কমরেড শান্তিময় ঘোষ বাচ্চুর সাথে আলোচনায় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন ভারতবর্ষ থেকে বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদকে হটাতে গেলে কৃষক সংগঠন ও কৃষক আন্দোলনের বিকল্প নাই। তাই তিনি জেনেশুনেই নিজ পরিবার আফরার জমিদারদের এলাকা এগারোখানের গরীব কৃষক রসিক ঘোষের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিলেন। সেই থেকে শুরু করে কৃষক সংগঠন ও কৃষক আন্দোলনে কমরেড অমল সেনের লড়াকু ভূমিকাকে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরবো।
চলবে/২০