
সালটা ২০১১। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রুটিন বৈঠক ছিল সেটা। তবে দীর্ঘ ১২ বছর পর ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী ওই সপ্তাহেই দ্বি-পক্ষীয় সফরে বাংলাদেশ আসেন, তাই ওই সফর সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও মিটিংয়ের অ্যাজেন্ডায় ছিল।
ওই সব কাগজপত্রের বান্ডিলে তিস্তা চুক্তি সংক্রান্ত একটি খসড়া দেখেই খটকা লাগে ক্যাবিনেটে তৃণমূল কংগ্রেসের একমাত্র সদস্য, দেশের রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর।
তৃণমূল তার মাত্র তিন-চার মাস আগেই ইতিহাস গড়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা ব্যানার্জি।
বৈঠকে মন্ত্রিসভার অনুমোদন চেয়ে চুক্তির যে খসড়াটি পেশ করা হয়েছিল, দীনেশ ত্রিবেদীর সন্দেহ হয়েছিল তা রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়াই চূড়ান্ত করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী তথা কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রণব মুখার্জির সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
অর্থমন্ত্রী হলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের সূত্র ধরে ভারতের হয়ে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি মূলত প্রণব মুখার্জিই তখন দেখছিলেন।
ত্রিবেদী যখন জানতে চান ওই চুক্তিতে রাজ্য সরকারের সম্মতি নেয়া হয়েছে কি-না, প্রণব মুখার্জির তখন বলেছিলেন, যেহেতু ভারতের সাথে আর একটা স্বাধীন দেশের চুক্তি হচ্ছে- এটি একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। এখানে রাজ্য সরকারের মতামত জরুরি নয়।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত এক সিনিয়র সদস্য ঘটনাটি বর্ণনা করেন।
বৈঠক শেষ করেই দীনেশ ত্রিবেদী সোজা কলকাতায় ফোন করেন মুখ্যমন্ত্রীকে। সব জানানো মাত্র মমতা ব্যানার্জি তাকে বলেন, খসড়া চুক্তির কাগজপত্র ওই রাতেই তাকে ফ্যাক্স করে পাঠাতে।
কাগজপত্র দেখেই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি তখনই বলেন, বাংলাদেশকে তিনি কখনোই শুষ্ক মৌসুমে ৩৩ হাজার কিউসেক পানি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেননি। কাজেই তাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তিস্তা চুক্তির বয়ান প্রস্তুত করা হয়েছে।
পরদিন সকালেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্য সচিব সমর ঘোষ দিল্লিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেন, ওই চুক্তি মেনে নেয়া তাদের পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব নয়।
শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি ঢাকাতেও আসবেন না বলে স্থির করে ফেলেন। ফলে বাংলাদেশ-সংলগ্ন ভারতের বাকি সবগুলো অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা ওই সফরে এলেও ছিলেন না শুধু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
ওই ক্যাবিনেট বৈঠকের শেষে পরের দু’তিন দিনে মমতা ব্যানার্জিকে বুঝিয়ে রাজি করানোর কম চেষ্টা করেনি দিল্লি।
প্রণব মুখার্জি নিজে তো বটেই, ক্যাবিনেটে তার সতীর্থ জয়রাম রমেশ থেকে শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) শিবশঙ্কর মেননসহ সবাই বারবার ফোন করে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ‘আপাতত এই চুক্তিতে রাজি হয়ে যান, পরে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ যেন সুরক্ষিত থাকে সেটা আমরা নিশ্চয় দেখব।’
কিন্তু না, কোনো অনুরোধে রাজি করানো যায়নি মমতা ব্যানার্জিকে। তার কথা, ওই আকারে চুক্তিটি মানা সম্ভব নয়।
মনমোহন সিং যেদিন ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন, তার আগের দিন বিকেলেই পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই ওই কথা নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘পানি আসলে অতি স্পর্শকাতর একটি বিষয়। আর ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আমরা এমন কিছু্ই করতে পারব না, যেন রাজ্য সরকারের আপত্তি আছে।’
ভারত সরকারের ওই উপলব্ধির পর ঠিক এক যুগ কেটে গেছে। ওই অবস্থানে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো নড়চড় হয়নি।
চুক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওই ‘আপত্তি’ যেমন বহাল আছে, তেমনি ভারত সরকারও তাদের সম্মতি ছাড়া এক পা এগোতে পারবে না- এটাও বহুবার পরিষ্কার করে দিয়েছে।
ফলে এক যুগ আগের ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার ওই তিস্তা ‘চুক্তি’ এখনো রয়ে গেছে গভীর পানিতে।
দিল্লির ব্যর্থতা ছিল যেখানে
দিল্লিতে বর্ষীয়ান সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল এক যুগ আগের ওই ঘটনাপ্রবাহ খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।
তার বলতে কোনো দ্বিধা নেই, তিস্তা চুক্তির মতো একটা স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল বিষয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের যেমন ‘মুন্সিয়ানার সাথে হ্যান্ডল করা উচিত ছিল। সেটা তখন আদৌ করা হয়নি।
ঘোষাল বলছিলেন, ‘বিষয়টা সত্যিই খুব তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছিল।’
তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ নেয়াটা, অর্থাৎ তাদের সম্মতি তো থাকবেই এটা ধরে নেয়াটাই দিল্লির সব চেয়ে বড় ভুল ছিল বলে এই সাংবাদিকের অভিমত।
জয়ন্ত ঘোষালের মতে, এর অবশ্য কিছু নির্দিষ্ট কারণও ছিল।
প্রথমত, কংগ্রেসের রাজনীতিতে একটা সময় মমতা ব্যানার্জি ছিলেন প্রণব মুখার্জির মেয়ের মতো। আলাদা দল তৃণমূল গড়ার পরেও মমতা ব্যানার্জি তাকে অনেকটা অভিভাবকের মতোই দেখতেন এবং প্রণব মুখার্জি হয়ত ধরেই নিয়েছিলেন যে মমতা তার কথা কিছুতেই ফেলতে পারবেন না।
কিন্তু মমতা নিজে যেহেতু জনমানুষের রাজনীতি করেন, তাই যে পদক্ষেপকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করা হতে পারে। তাতে সায় দেয়া তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না, আর তিনি দেননি।
দ্বিতীয়ত, এই ঘটনার ঠিক ১৫ বছর আগে ১৯৯৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়ার আমলে বাংলাদেশের যে গঙ্গা জলচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সানন্দ সম্মতি ছিল।
জয়ন্ত ঘোষাল বলেন, ‘বস্তুত ওই চুক্তির সম্পাদনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর খুব বড় একটা ভূমিকা ছিল। প্রণব বাবুরা হয়ত ভেবে নিয়েছিলেন, গঙ্গা চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গ যেহেতু সায় দিয়েছে তাই তিস্তাতেও তারা অরাজি হবে না।’
জাঁদরেল কূটনীতিক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শিবশঙ্কর মেনন তখন দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা। মমতা ব্যানার্জির সাথে কথা বলে তাকে ড্যামেজ কন্ট্রোলের যে দায়িত্ব দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার, সেটাও কোনো কাজে আসেননি।
ওই সময়ের ঘটনাবলীর সাক্ষী এক সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, শিবশঙ্কর মেনন বিন্দুমাত্র বাংলা বোঝেন না। মমতা ব্যানার্জির সাথে তার যেকোনো কেমিস্ট্রি গড়ে ওঠেনি এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।’
এই প্রতিবেদনের জন্য এখন অবসরপ্রাপ্ত শিবশঙ্কর মেননের বক্তব্য জানতে চেয়ে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কথা বলতে চাননি।
তবে ওই সময় ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রী ছিলেন পবন কুমার বনসল। তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন, তার মন্ত্রণালয় চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করলেও মমতা ব্যানার্জির সাথে তার একবারও ওই বিষয়ে কোনো কথাবার্তা হয়নি।
চন্ডীগড় থেকে প্রবীণ ওই কংগ্রেস নেতা বলেছিলেন, ‘পুরো ঘটনাটা যখন ঘটছে, আমার সাথে একবারও মমতা ব্যানার্জির দেখা হয়নি বা কথা হয়নি। এখন মনে হয় হলে হয়ত ভালো হতো।’
বনসল আরো জানিয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরে চুক্তিটা সই হয়ে যাবে এ ব্যাপারে তারা খুবই আশাবাদী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেটা না হওয়াতে সরকার খুবই হতাশ হয়েছিল।
তবে এটাকে তিনি ঠিক মনমোহন সিং সরকারের ব্যর্থতা বলে মানতে রাজি নন।
পবন কুমার বনসল বলেন, ‘দেখুন, আপনি অনেকগুলো কাজ নিয়ে ঝাঁপালে কোনোটায় সফল হবেন, কোনোটায় হয়ত হবেন না। এটাও তেমনই একটা, আমি বিষয়টাকে ওই রকম নির্লিপ্তি দিয়েই বিচার করতে চাই।’
তবে পুরো বিষয়টা যে ভারত সরকারের কাছে চরম অস্বস্তিকর ছিল, তা ওই সময়কার কর্মকর্তাদের মন্তব্যেই আজও স্পষ্ট।
যেমন ওই সময় ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনার ছিলেন রাজিত মিটার। চুক্তি সম্পাদনে ব্যর্থতা নিয়ে তার কাছে জানতে চাইতেই সাবেক ওই কূটনীতিক মার্জনা চেয়ে নেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে দয়া করে ছেড়ে দিন, আমি ওগুলো নিয়ে কথা বলতে পারব না। আসলে অনেক দিন আগের কথা তো, আমি ওই সব ভুলেও গেছি।’
পশ্চিমবঙ্গের যুক্তি
কেন তিনি ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তুত করা তিস্তা চুক্তির খসড়ায় সায় দেননি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি কখনো ওই প্রশ্নের উত্তর দেননি।
তবে মমতা ব্যানার্জি এটা বারেবারেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, রাজ্যবাসীর স্বার্থের সাথে আপস করে তিনি কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সম্মতি দিতে পারবেন না।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রথম ক্যাবিনেটে সেচমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন রাজিব ব্যানার্জি। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলো বঞ্চিত হবে- এমন আশঙ্কা থেকেই তখন রাজ্য সরকার ওই চুক্তিতে আপত্তি জানিয়েছিল।
মমতা ব্যানার্জির কথায়, ‘মুশকিলটা হলোল ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় বা ফেডারেল কাঠামোয় সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের সাথে কোনো আলোচনা না-করে বা মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি না-নিয়ে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। আর ঠিক সেখানেই একটা গ্যাপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল।’
তবে তিনি একই সাথে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মমতা ব্যানার্জি কিন্তু স্রেফ ‘বিরোধিতার জন্য চুক্তির বিরোধিতা’ করেননি। বরং তিনি বিভিন্ন বিকল্প প্রস্তাব পেশ করে বরাবরই বাংলাদেশের সাথে পানি ভাগাভাগি করতে চেয়েছেন।
রাজিব ব্যানার্জি বলছিলেন, ‘আমাদের উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা চাষাবাদ ও অন্য নানা প্রয়োজনে তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। রাজ্য সরকার তখন মনে করেছিল চুক্তিটি যে আকারে পেশ করা হচ্ছে তাতে ওই এলাকার মানুষজন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু পরে বিভিন্ন বৈঠকে তিস্তা ছাড়া ওই এলাকার আরো বহু নদীর পানি বাংলাদেশকে দেয়া যায় কি-না, তা ভেবে দেখার কথা বলেছেন। কাজেই তিনি বাংলাদেশকে পানি দেয়ার বিরোধী ছিলেন, তা মোটেই নয়।’
বস্তুত ২০১৭ সালের এপ্রিলে দিল্লিতে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে মমতা ব্যানার্জির দেখা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু তাকে তোর্সা, মানসাই বা ধরলার মতো উত্তরবঙ্গের অন্য নদীগুলো থেকে পানি দেয়ার বিকল্প প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।
তবে ২০১১ সালেই মমতা ব্যানার্জির আপত্তি মেনে নিতে কেন্দ্রীয় সরকার একরকম বাধ্য হয়েছিল।
কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা তখন লিখেছিল, ‘মনমোহন সিংও (মমতা ব্যানার্জির সাথে) সঙ্ঘাতের পথে যেতে আগ্রহী নন। কারণ ইউপিএ সরকারের সঙ্কটকালে লোকসভায় ১৯ জন তৃণমূল সংসদ সদস্যের সমর্থন তার খুবই দরকার।’
ফলে প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের ঠিক আগে পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই তার মিডিয়া ব্রিফিংয়ে তিস্তা চুক্তি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের ফেডারেল কাঠামোতে রাজ্য সরকারের সাথে আলোচনা ছাড়া কিছুই করা যায় না, কিছু করা হবেও না। ওই সমঝোতাই আমরা করি না কেন, তা রাজ্য সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। পাশাপাশি, সেটা বাংলাদেশের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এই জিনিসটা আমাদের খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে।’
আর এটাই ওই মুহূর্তে ভারতের অবস্থান বলেও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন তিনি।
বাস্তবতা হলো, ওই ‘অবস্থান’ অপরিবর্তিত থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও বাংলাদেশ- উভয়েরই সম্মতি থাকবে এমন একটি চুক্তির খসড়া তৈরিতে ভারত কিন্তু আজ ১২ বছর পরেও এক পা আগাতে পারেনি।
খসড়া চুক্তিতে ঠিক কী ছিল?
মমতা ব্যানার্জির সম্মতি ছাড়াই ভারত ও বাংলাদেশ সরকার ২০১১ তে তিস্তা চুক্তির যে বয়ান নিয়ে একমত হয়েছিল, তাতে ঠিক কী ছিল তা আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই প্রকাশ করা হয়নি।
তবে ভারতের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম তখন লিখেছিল, ওই চুক্তিতে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে ৩৩ হাজার কিউসেক হারে তিস্তার পানি দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছিল।
মমতা ব্যানার্জি প্রথমে ২৩ হাজার কিউসেক, পরে তা বাড়িয়ে বড়জোর ২৫ হাজার কিউসেক পর্যন্ত করে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু ৩৩ হাজার কিউসেক তিনি কিছুতেই মানতে চাননি বলেই চুক্তিটা হয়নি, এমনটাও লিখেছিলেন কোনো কোনো সাংবাদিক।
তবে ওয়াকিবহাল মহলের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভণ্ডুল হওয়া ওই তিস্তা চুক্তিতে পানির পরিমাণ নয়, বরং শতকরা হারের ওপর ভিত্তি করেই পানি ভাগাভাগির ফর্মুলাটা চূড়ান্ত করা হয়েছিল।
চুক্তির ওই খসড়া তৈরির কাজে জড়িত ছিলেন এমন একজন নদী-বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘মোটামুটিভাবে ফর্মুলাটা ছিল এমন- শীতের মাসগুলোতে তিস্তার একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টে যে পরিমাণ প্রবাহ থাকবে, তার ৩৭.৫ শতাংশ বাংলাদেশ আর ৩৭.৫ শতাংশ ভারত ব্যবহার করতে পারবে। এতে হলো মোট ৭৫ শতাংশ। আর বাকি ২৫ শতাংশ তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহটা বজায় রাখার জন্য ছেড়ে দিতে হবে, এটাই স্থির হয়েছিল।’
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে ঢাকাতে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের পর দু’দেশ কিন্তু তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি ‘অ্যাড-হক অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা সাময়িক সমঝোতায় রাজি হয়েছিল।
ভারতের তদানীন্তন পানিসম্পদ মন্ত্রী রামনিবাস মির্ধা ও বাংলাদেশে তার কাউন্টারপার্ট এ জেড এম ওবায়দুল্লা ওই নথিতে স্বাক্ষরও করেছিলেন।
যদিও অনেকেই সেটিকে ‘চুক্তি’ বা ‘সমঝোতা’ বলতে রাজি নন। তবুও প্রায় আড়াই বছর টিঁকেছিল ওই ব্যবস্থা। তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সেটাই প্রথম কোনা কার্যকরি ফর্মুলা, আর এখন অবধি সেটাই শেষ।
ওই অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনায় ভারত তিস্তার পানিপ্রবাহের ৩৯ শতাশ আর বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ ব্যবহার করতে পারবে বলে জানানো হয়েছিল। বাকি ২৫ শতাংশ নদীতে বয়ে যেতে দিতে হবে, এমনই স্থির হয়েছিল।
২০১১ সালে যে চুক্তির খসড়া প্রস্তুত হয়, তাতে কিন্তু দু’দেশেরই ভাগ ছিল সমান-সমান, ৩৭.৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১৯৮৩ সালের সমঝোতার তুলনায় ভারত নিজের ভাগ থেকে আরো ১.৫ শতাংশ বাংলাদেশকে দিতে রাজি হয়েছিল।
কিন্তু দিল্লিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তখনকার রাজনৈতিক অবিবেচনা আর পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর অনমনীয় মনোভাব ও আপত্তিতেই ওই চুক্তি আজ পর্যন্ত দিনের আলো দেখতে পারল না।
সূত্র : বিবিসি