স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেছেন, আমি ব্যারেজের বিরুদ্ধে। ফারাক্কা ভেঙে দেয়ার পক্ষে। আমরা যদি নদীকে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করতে পারি, তাহলে সমস্যার অনেকাংশেই সমাধান হবে।
বৃহস্পতিবার সিরডাপ মিলনায়তনে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘নদীর অধিকার-নদীতে অধিকার’ বিষয়ক সংলাপে একথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সঙ্গে ভারতসহ এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটা মনস্তাত্ত্বিক বৈরিতা রয়েছে। এসব আঞ্চলিক রাজনীতির কারণেও নদী নির্যাতিত হচ্ছে।
এতে নদীবিষয়ক নীতি-নির্ধারক, বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা বলেন, নদী রক্ষায় বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন ও নীতিমালা না থাকায় রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদী হত্যা করছে। আবার সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নদী রক্ষার উদ্যোগকে বাধা দিচ্ছে রাজনৈতিক কর্মীরা। যার মূলে রয়েছে ভোটের রাজনীতি।
তারা আরো বলেছেন, সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় নদী রক্ষায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে পারছে না বাংলাদেশ। যার খেসারত দিচ্ছে এদেশের মানুষ।
একশনএইড বাংলাদেশ গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে নদী ও পানির অধিকার রক্ষায় যে কাজ করছে তার অংশ হিসেবে এই সংলাপের আয়োজন।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই সংস্থাটির ম্যানেজার শসসের আলী বলেন, ‘মানুষের অমানবিক কাজে নদী মরে যাচ্ছে। ক্ষুন্ন হচ্ছে পানি ও নদীর অধিকার। পানির সংকটের ফলে নদীপাড়ের মানুষ তাদের জীবিকা হারাচ্ছে।’
অলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন বলেন, ‘আমাদের সরকারের নদী নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই। নেই নদী রক্ষায় কোনো আইন। হাইকোর্টের রায় আছে নদী রক্ষার্থে। কিন্তু সরকার ও প্রভাবশালীরা সেটা মানছে না। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা চাইছে না নদী রক্ষা করতে। সরকারের দুর্বলতার কারণে রাজনৈতিক কর্মীরা নদী রক্ষায় বাধা দিচ্ছে।’
নদী বিষয়ক আইন বিশেষজ্ঞ হাসনাত কাইয়ূম বলেন, ‘বাংলাদেশে কয়েকশ’ নীতি আছে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, বাংলাদেশে কোনো নদী নীতিমালা নেই। ফলে নদীকে যে যার মতো করে হত্যা করছে।’
নদীর এই পরিস্থিতি নিয়ে সংসদ সদস্য টিপু সুলতান বলেন, ‘আমরা আমাদের নিজেদের স্বার্থে নদীর উপর অত্যাচার করি। যে নদী আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে, সেই নদীকে আমারা দখল করছি। মেরে ফেলছি। ভোটের রাজনীতির কারণে আমরা জনপ্রতিনিধিরা অনেক সময় নদী রক্ষায় প্রতিবাদ করতে পারি না।’
নদী রক্ষায় সরকারি কাঠামো নিয়ে কথা বলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য শারমিন মুরশিদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নদী ও পানির অধিকার রক্ষায় নদী কমিশন করা হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলো, নদী কমিশন এখন একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান। গেল তিন মাস ধরে চেয়ারম্যান নেই। এটি একটি অসম্পূর্ণ কাঠামোর মধ্যে রয়েছে। গবেষণা ও কাজের জন্য নেই পর্যাপ্ত বাজেট। ফলে নদীর জন্য কাজ করতে পারছে না নদী কমিশন।’
তিনি আরো বলেন, ‘নদী বাঁচাতে গবেষণায় জোর দিতে হবে। বাড়াতে হবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা। নদীর জন্য আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা অত্যন্ত দুর্বল। নিজেরা যখন নড়বড়ে কাজ করি, তখন আন্তর্জাতিকভাবে আমরা দুর্বল হয়ে যাই। নদী বাঁচাতে তাই আন্তর্জাতিক শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে।’
এই প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘দুঃখের বিষয় হলো নদী নিয়ে আমাদের যথাযথ পরিসংখ্যান নেই। বাঁধগুলো নদীর জন্য ক্যান্সারের মতো। বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র বাঁচাতে নদী রক্ষা করতেই হবে। তাই শক্তিশালী করতে হবে নদী কমিশনকে। প্রয়োজন আলাদা মন্ত্রণালয়ের।’
একশনএইড বাংলাদেশের পরিচালক আসগর আলী সাবরি বলেন, ‘নদীর নিজস্ব একটা অধিকার আছে। সেটা রক্ষা করতেই হবে। তা না হলে আমাদের ইতিহাস, কৃষি, অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই আইন, কাঠামো ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে নদী রক্ষা করতেই হবে।’
অনুষ্ঠানে পানি ও নদী অধিকার রক্ষায় কিছু সুপারিশ তুলে ধরে একশনএইড বাংলাদেশ। তার মধ্যে রয়েছে, নদীর জন্য আইন ও নীতিমালা তৈরি; নদীসহ সকল জলাধার নির্মিত পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতিকর সকল স্লুইস গেইট, ড্যাম ও অন্যান্য কৃত্রিম স্থাপনা অপসারণ; পানি সংক্রান্ত যেকোন দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক আলোচনা বিষয়ে জনগণকে জানার সুযোগ দেয়া; জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আরো শক্তিশালী করা।