এক কথায় অবিশ্বাস্য, অভাবনীয়। ৪৫ রানে নেই ছয় উইকেট। সেখান থেকে ২১৬ রান ছিল অনেক দূরের ব্যাপার। কিন্তু সপ্তম উইকেটে আফিফ হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজ যা করে দেখালেন, তা অকল্পনীয়। আফগান বোলারদের নাচিয়ে এই জুটি গড়ল রেকর্ড। অটল চিত্তে দাঁড়িয়ে গেলেন দুজনই। দুজনই খেললেন ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। যেখানে হারের শঙ্কা ছিল চরমে, সেখানে এই জুটির বীরোচিত ইনিংসে জিতল বাংলাদেশ।
প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে বুধবার চট্টগ্রামে আফগানিস্তানকে ৪ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। আগে ব্যাট করতে নেমে আফগানিস্তান ২১৫ রানে অল আউট। জবাবে শুরুতে ধুকলেও মিরাজ-আফিফের ব্যাটে বাংলাদেশ লক্ষ্যে পৌঁছায় ৭ বল হাতে রেখে, ২১৯/৬।
তৃতীয় ওভারে প্রথম আঘাত। ফজলহক ফারুকির বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ওপেনার লিটন দাস। আম্পায়ার যদিও প্রথমে আউট দেননি। রিভিউ নিয়ে সফল হয় আফগানিস্তান। ৮ বলে লিটন করতে পারেন মাত্র ১ রান। একই ওভারের পঞ্চম বলে বিদায় নেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ৮ বলে ২ চারে ৮ রান করে তিনি ফারুকির এলবিডব্লিউর শিকার। এবারো আম্পায়ার আগে আঙুল তোলেননি। রিভিউ নিয়ে সফল হয় আফগানিস্তান। একই ওভারে দুই রিভিউ নিয়ে বাংলাদেশের দুই ওপেনারকে ফেরায় আফগানরা।
শুরুর বিপর্যয় রোধ করতে পারেননি অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম। ফারুকির পঞ্চম ওভারের প্রথম বলে তিনি এলবির শিকার। রিভিউ নেন মুশফিক। কাজে দেয়নি। রিপ্লেতে দেখা যায় বল লাগতো অফ মিডল স্টাম্পে। ৫ বলে মুশফিক করতে পারেন মাত্র ৩ রান। একই ওভারের শেষ বলে আবার ফারুকি ঝলক। এবার তিনি বোল্ড করে দেন অভিষিক্ত ইয়াসির আলী রাব্বিকে। ৫ বল খেলেও রানের খাতা খুলতে পারেননি রাব্বি। অভিষেকটা তাই বিষাদের হলো তরুণ এই ব্যাটারের।
সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ চেষ্টা করেন প্রতিরোধ গড়তে। কিন্তু সেটাও বেশিক্ষণ টেকেনি। স্পিনার মুজিব উর রহমানের বলে বিদায় নেন সাকিব। হয়ে যান বোল্ড। ১৫ বলে ১ চারে তিনি করেন ১০ রান। ২৮ রানে নেই বাংলাদেশের ৫ উইকেট। এমন অবস্থায় দলের হাল ধরেন মাহমুদউল্লাহ ও আফিফ হোসেন। রক্ষণাত্মক ব্যাটিংয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন দুজন। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। ১২তম ওভারে রশিদ খানের আঘাত। ১৭ বলে ৮ রান করে গুলবাদিনের হাতে ক্যাচ দেন মাহমুদউল্লাহ। ৪৫ রান তুলতেই শেষ বাংলাদেশের ৬ উইকেট।
এখান থেকে অবিশ্বাস্যভাবে দলের হাল ধরেন মেহেদী হাসান মিরাজ ও আফিফ হোসেন। হারের শঙ্কা যখন প্রবল, তখন দুজনের ব্যাটে ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে শঙ্কা। আফগান বোলারদের চাপ সামলে দক্ষতার সাথে রানের চাকা সচল রাখেন তারা। একদিকে উইকেট ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে রান করার তাগিদ। দুজনে ছিলেন সেদিক থেকে বেশ অবিচল। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি পেয়ে যান আফিফ হোসেন ধ্রুব। ৬৪ বলে পূর্ণ করেন ৫০। ৫টি চারের পাশাপাশি ১টি ছক্কা ছিল তার ফিফটির ইনিংসে।
মেহেদী হাসান মিরাজ ছিলেন একটু ধীরলয়ে। একসময় তিনিও পূর্ণ করেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফিফটি। ৭৯ বলে তিনি স্পর্শ করেন ৫০। চার ছিল মাত্র ৬টি। দুজনের সাবলিল ব্যাটে শঙ্কা কাটিয়ে জয়ের আশায় তখন বাংলাদেশ। সপ্তম উইকেটে দুজনে ১০০ পূর্ণ করেন ১৪১ বলে। এর মধ্যে অতিরিক্ত ছিল ১৪।
ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসে দুজনে এক সময় রেকর্ড গড়েন সপ্তম উইকেট জুটিতে। ছাড়িয়ে যায় ইমরুল কায়েস ও সাইফউদ্দিনের ১২৭ রান। দল তখন জয়ের আশায় উজ্জ্বল। শেষটা সুখজাগানিয়াই। এই জুটিকে আর বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি আফগানিস্তান। অবিচ্ছিন্ন থেকে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন দুজন। এই জুটিতে আসে রেকর্ড ১৭৪ রান, ২২৫ বলে।
৯৩ রানে অপরাজিত থাকেন আফিফ হোসেন। ১১৫ বলের ইনিংসে তিনি হাঁকান ১১টি চার ও একটি ছক্কা। ১২০ বলে ৮১ রানের ইনিংস খেলে অপরাজিত থাকেন মিরাজ। তার ইনিংসে ছিল ৯টি চারের মার। নেই কোনো ছক্কা।
এর আগে টস জিতে ব্যাট করতে নামা আফগানদের বিরুদ্ধে তৃতীয় ওভারে বল হাতে সাফল্য পায় বাংলাদেশ। তৃতীয় বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে আকাশে ক্যাচ তুলে দেন রহমানউল্লাহ। বেশ দক্ষতার সাথে সেই ক্যাচ লুফে নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ১৪ বলে ৭ রান করেন রহমানউল্লাহ।
দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে প্রতিরোধ গড়েন ইব্রাহিম ও রহমত শাহ। এই জুটি ভাঙেন শরিফুল। ইব্রাহিম স্লিপে ক্যাচ দেন। প্রথম চেষ্টায় ধরতে পারেননি ইয়াসির, তবে হাত ও শরীর দিয়ে কোনোমতে বলের পতন ঠেকান অভিষিক্ত এই ক্রিকেটার। ভাঙে ৬৫ বলে গড়া ৪৫ রানের জুটি। ৩ রানে মাহমুদউল্লাহর হাতে জীবন পাওয়া ইব্রাহিম একটি করে ছক্কা ও চারে ২৩ বলে করেন ১৯।
এরপর উইকেটের দেখা পান তাসকিন আহমেদ। সেটাও দ্বিতীয় স্পেলে। তিনি ফেরান থিতু ব্যাটসম্যান রহমত শাহকে। তাসকিনের বাড়তি বাউন্স করা বলে ব্যাট চালিয়ে দেন রহমত। ব্যাটের কানায় লেগে আসা সহজ ক্যাচ গ্লাভসে নেন মুশফিকুর রহিম। ভাঙে ৫২ বল স্থায়ী ২৩ রানের মন্থর জুটি। ৬৯ বলে ৩ চারে ৩৪ রান করেন রহমত।
অধিনায়ক হাসমতউল্লাহ ভালোই খেলছিলেন মোহাম্মদ নবীকে সাথে নিয়ে। দলীয় রান ১০০ পার হতেই আফগান অধিনায়ককে ফেরান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন হাসমতউল্লাহ। ৪৩ বলে ৩ চার ও ১ ছক্কায় ২৮ রান করেন তিনি।
রানের জন্য হাসফাস করা আফগানিস্তানকে একটু স্বস্তি দেন নাজিবুল্লাহ জাদরান। মোহাম্মদ নবীকে সাথে নিয়ে রানের চাকা সচল রাখেন তিনি। এই জুটিতে আসে ৬৩ বলে ৬৩ রান। অবশেষে এই জুটি ভাঙেন তাসকিন। দলীয় ১৬৫ রানের মাথায় তাসকিনের বলে উইকেটের পেছনে মুশফিকের গ্লাভসে ক্যাচ দেন নবী। যাওয়ার আগে তিনি করে যান ২৪ বলে দুই চারে ২০ রান।
গুলবাদিন নাইবকে সাথে নিয়ে এরপর আগাতে থাকেন নাজিবুল্লাহ। দলীয় ১৯৪ রানের মাথায় এই জুটি ভাঙেন সাকিব আল হাসান। শুধু তাই নয় ৪৫তম ওভারেই তিনি নেন দুটি উইকেট। প্রথমে এলবিডব্লিউ করেন গুলবাদিনকে। ২১ বলে ১৭ রান করেন তিনি। একই ওভারের শেষ বলে বোল্ড করেন আফগান স্পিনার রশিদ খানকে। তিন বল খেললেও রানের খাতা খুলতে পারেননি রশিদ।
৪৬তম ওভারে মুজিব উর রহমানকে শান্তর ক্যাচ বানান মোস্তাফিজুর রহমান। মুজিবও রানের খাতা খুলতে পারেননি রশিদের মতো। দলীয় ১৯৫ রানে আফগানরা হারায় ৮ উইকেট, ওভার ৪৫.৫।
৪৯তম ওভারে শেষ পর্যন্ত বিদায় নেন নাজিবুল্লাজ জাদরান। শরিফুলের বলে তিনি ক্যাচ দেন মাহমুদউল্লাহর হাতে। তার ব্যাটেই আসে ইনিংস সর্বোচ্চ রান। ৮৪ বলে ৪টি চার ও ২ ছক্কায় তিনি করেন ৬৭ রান। ইয়ামিন আহমেদজাইকে আউট করে আফগানদের ইনিংসে সমাপ্তি টানেন মোস্তাফিজুর রহমান। ৪৯.১ ওভারে ২১৫ রানে অল আউট হয় আফগানিস্তান।
বল হাতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নেন মোস্তাফিজুর রহমান। ৯.১ ওভারে মাত্র ৩৫ রান দেন তিনি। তবে সবচেয়ে কম ইকোনমি শরিফুলের। ১০ ওভারে এক মেডেনে ৩৮ রানে তিনি নেন দুটি উইকেট। সাকিব ও তাসকিন একটু মার খেলেও নেন দুটি করে উইকেট। এক ওভার বল করে মাহমুদউল্লাহ পান এক উইকেট।