স্বীকৃতি বিশ্বাস, যশোরঃ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরুর প্রাক্কালে মহালয়ার দিন চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে মর্ত্যলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। মহালয়া দুর্গোৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মহালয়া’ শব্দটির অর্থ- মহান যে আলয় বা আশ্রয় । “মহালয়া”শব্দটিকে স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কারণ এই দিনেই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের শুভারম্ভ হয়। এখানে দেবী দুর্গাই হলেন সেই মহান আলয় বা আশ্রয় ৷পিতৃপক্ষের শেষক্ষণ ও দেবীপক্ষের সূচনাকালের সময়কেই মহালয়া বলা হয়।
পুরাণ অনুসারে প্রলয়কালে পৃথিবী এক বিরাট কারণ-সমুদ্রে পরিণত হলে শ্রীবিষ্ণু সেই সমুদ্রের উপর অনন্তনাগকে শয্যা করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হলেন। এই সময় বিষ্ণুর কর্ণমূল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্য নির্গত হয়ে বিষ্ণুর নাভিপদ্মে স্থিত ব্রহ্মাকে বধ করতে উদ্যত হল। ভিত হয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগরিত করবার জন্য তাঁর নয়নাশ্রিতা যোগনিদ্রাকে স্তব করতে লাগলেন। সৃষ্টি হয়ে দেবী শ্রীবিষ্ণুকে জাগরিত করলে তিনি পাঁচ হাজার বছর ধরে মধু ও কৈটভের সাথে মহাযুদ্ধে রত হলেন। পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ হচ্ছে মহালয়া।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ প্রতিপদ শুরু হয়ে পরর্বতী অমাবস্যা পর্যন্ত সময়কে পিতৃ পক্ষ বলে। পুরাণ মতে ব্রহ্মার নির্দেশে পিতৃপুরুষরা এই ১৫ দিন মনুষ্যলোকের কাছাকাছি চলে আসনে। তাই এই সময় তাঁদরে উদ্দেশ্যে কিছু অর্পণ করা হলে তা সহজেই তাদের কাছে পৌছায়। তাই গোটা পক্ষকাল ধরে পিতৃপুরুষদেব স্মরণ ও মননের মাধ্যমে তর্পণ করা হয়। যার চূড়ান্ত প্রকাশ বা মহালগ্ন হল এই মহালয়া। অনেকেই এই দিনটিকে দেবীপক্ষের সূচনা বলে থাকেন। এটি একটি জনপ্রিয় কৃতকর্ম। মহালয়া পিতৃপক্ষের শেষ দিন। পরের দিন শুক্লা প্রতিপদে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। সেই দিন থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত ১৫ দিনই হল দেবীপক্ষ।
মহালয়া মানে দূর্গাপূজার দিন গোনা শুরু। মহালয়ার ৬ দিন পর মহাষষ্টী তাই দেবীকে আমন্ত্রণ ইত্যাদি। মহালয়ার তার চেয়ে বড় গুরুত্ব আছে ।ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য। আসল দূর্গা পূজা হলো বসন্তে, সেটাকে বাসন্তি পূজা বলা হয় । শ্রীরামচন্দ্র অকালে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবীর অকাল-বোধন বলা হয় ।
সনাতন ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বরা, যাদের পিতা-মাতা তাদের পিতা-মাতার জন্য, সাথে সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, কার্যাদি-অঞ্জলিপ্রদান করতে হয় । তর্পণ মানে খুশি করা । ভগবান শ্রীরাম চন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে এদিনে এমনই করেছিলেন ।
সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরূষের স্মরন করে, পূর্বপূরুষের আত্নার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন । সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্নাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, প্রয়াত আত্নার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া । পিতৃপক্ষের ও শেষদিন এটি ।
সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে একবার পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে পিন্ড দান করতে হয়, সেই তিথিতে করতে হয় যে তিথিতে উনারা প্রয়াত হয়েছেন । সনাতন ধর্মের কার্যাদি কোন তারিখ অনুসারে করা হয় না । তিথি অনুসারে হয় ।
মহালয়াতে যারা গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বদের আত্নার শান্তির জন্য, তাহারা শুধু পূর্বদের নয় , পৃথিবীর সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন ।
যে-অবান্ধবা বান্ধবা বা যেন্যজন্মনি বান্ধবা – অর্থাৎ যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধু ও, যারা জন্ম জন্মাত্নরে আমার আত্নীয় বন্ধু ছিলেন, তারা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহন করুন।
যাদের পুত্র নেই, যাদের কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদের জন্য ও অঞ্জলী প্রদান করতে হয়।
হিন্দু শাস্ত্র বলতে আমরা মুখ্যত বেদ, উপনিষদ এবং গীতাকেই বুঝব। বেদ-উপনিষদের সারাৎসার “অমৃতরূপ দুগ্ধ”। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় সাংখ্যযোগের ২৭ নম্বর শ্লোকে, শ্রীভগবানের মুখে বেদব্যাস রচনা করেছেন এইরকম কথা, যে জন্মেছে তার জন্য মৃত্যু নিশ্চিত আবার যার মৃত্যু হয়েছে তার পুনর্জন্মও নিশ্চিত (কারণ ‘আত্মজ্ঞান’ লাভ করে মুক্তি না হওয়া অবধি এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র চলতেই থাকবে), অতএব যা নিশ্চিত তার জন্য শোক করা নিতান্ত মূর্খামি। ‘ন হন্যতে’ ইত্যাদি শ্লোক তো আমরা জানিই। তাই পিতৃপুরুষের পার্বণ শ্রাদ্ধ শোকের নয়।
সদ্যমৃত প্রেতের একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ এবং অশৌচান্তে আদ্যশ্রাদ্ধও শাস্ত্রানুযায়ী শোকের নয়, তবে সদ্য প্রিয়জনের বিয়োগব্যথার কারণে ‘মায়াবদ্ধ’ জীবের কাছে সেটি শোকের। কিন্তু অন্নপ্রাশন এবং বিবাহের শুরুতে যে বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ হয় সেটি, অথবা চান্দ্র ভাদ্রের পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা (মহালয়া) অবধি যে অপরপক্ষীয় পার্বণশ্রাদ্ধ হয় তাতে শোকের জায়গা কোথায়? হিন্দুশাস্ত্রোক্ত এই তিনধরনের শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকালও ভিন্ন। বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ হয় পূর্বাহ্নে, একোদ্দিষ্ট এবং আদ্যশ্রাদ্ধ মধ্যাহ্নে এবং বাৎসরিক সপিণ্ডীকরণ ও অপরপক্ষীয় পার্বণশ্রাদ্ধ অপরাহ্নে কৃত্য। আমাদের বাঙালি সমাজের লোকাচারে পিণ্ডদান সম্পর্কে অদ্ভুত ভীতিপ্রদ কিছু ধারণা বিদ্যমান, যার কোনও শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা নেই।
সেগুলি এরকম, যাদের পিতা-মাতা বর্তমান তারা পিণ্ডদান দেখতে পারবে না, এমনকি শ্রাদ্ধসম্পর্কিত কোনও কিছুই করতে পারবে না ইত্যাদি এবং এতে তাদের পিতা-মাতার জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে। অথচ এ অতি পুণ্য কাজ এবং শাস্ত্রমতে এটিই অন্যতম ‘কাজ’ যা করে শতবর্ষব্যাপী ধার্মিক জীবন যাপন শেষে দেবদুর্লভ পিতৃলোকে গমন সম্ভব। প্রেতের শ্রাদ্ধে শোকের অনুষঙ্গ থাকলেও বৃদ্ধিশ্রাদ্ধে বা পার্বণ শ্রাদ্ধে শোক ত নয়ই, বরং উদ্যাপনের অনুষঙ্গ রয়েছে। হিন্দু শাস্ত্রানুযায়ী এই সাতপুরুষকে জল দেওয়ার রীতিও বড় মায়াময়।
আস্তিক-নাস্তিক-সংশয়বাদী, আপনি যাই হোন না কেন, কোনওভাবেই পিতৃপুরুষকে অস্বীকার করতে পারবেন না। আপনার এক্স-ওয়াই সহ সমস্ত ক্রোমোজোম যেখান থেকে পেয়েছেন, সেই মানুষগুলোকে অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। মার্কণ্ডেয় ঋষির কাব্যই হোক বা পুরাকালে বাস্তবে মহিষাসুর আদৌ বধ হয়ে থাকুক না কেন, সেই চর্চা আপনার পক্ষে সাধনার বিষয়। কিন্তু পিতৃপুরুষদের বছরে অন্তত একদিন স্মরণ করা, সেটি তো ভীষণ ভাবেই মানবিক। আপনি নাস্তিক হলেও, পিতৃলোকে অবিশ্বাসী হলেও, আপনার পিতৃপুরুষদের অতীতকে অবিশ্বাস করতে পারেন না। তাঁরা ছিলেনই। আপনি যদি পিতৃকুল সম্পর্কেই অনবহিত থাকেন অথবা বীতশ্রদ্ধ হন, তাহলেও এই দিনটি আপনার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ হিন্দুশাস্ত্র পিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পাঁচরকম পিতার উল্লেখ করেছে, এবং বীর্যদাতা পিতাকে শেষের দিকেই রেখেছে।
শাস্ত্র বলছে, যিনি অন্ন দেন (পালনকারী পিতা), যিনি ভয় দূর করেন (অন্ধকার থেকে যিনি আলোয় নিয়ে যান তাই অন্ধকারের ভয় দূর হয়, গুরু, শিক্ষক প্রমুখ), যিনি কন্যাদান করেন (শ্বশুর), যিনি বীর্যদান করেন (বায়োলজিকাল ফাদার), যিনি উপনয়ন দান করেন (পুরাকালে তিন বর্ণের উপনয়নের ব্যবস্থা ছিল) এনারা সকলেই পিতা। এখন আপনি বীর্যদাতা পিতার উদ্দেশ্যে তর্পণ করলেন নাম গোত্র উল্লেখ করে, কিন্তু প্রণাম করবার সময় আপনি এই পাঁচ পিতাকেই প্রণাম করলেন। চাইলে আপনি এই পাঁচজনকেই জলদান করতে পারেন।
আমরা যে বাংলায় সাতপুরুষ, চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করি তাঁরা হলেন, পিতৃকূলে পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, মাতৃকূলে মাতামহ, প্রমাতামহ এবং বৃদ্ধ প্রমাতামহ। এনারা ত হলেন পূর্বতন ছয় পুরুষ ও সপিণ্ডের অধিকারী। এই ছয়পুরুষকে দেবার আগে প্রথম পিণ্ডদান করা হয় অগ্নিদগ্ধ, অস্ত্রাঘাতে হত ইত্যাদি অপঘাতে মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে। চৌদ্দপুরুষ বলতে এনাদের সকলের স্ত্রীসহ বোঝানো হয়। মহালয়ার দিন পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা অবধি ষোলো দিনে মোট ষোলোটি পিণ্ডদানের নির্দেশ রয়েছে শাস্ত্রে। অপারগ হলে কেউ পনেরোদিন ধরে, কেউ অষ্টমী থেকে আটদিনে, তাও না পারলে একাদশী থেকে পাঁচটি, তাতেও অপারগ হলে ত্রয়োদশী থেকে তিনদিন পার্বণ শ্রাদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে৷ মহালয়ার দিন তিনভুবনের সমস্ত জীবের তৃপ্তির জন্য জলদান করা হয়। একে শোকের বলা অমানবিক হবে।
একইরকমভাবে কার্তিকমাসে দীপদান হয়। আজ যে আমরা কালীপুজোয়-দীপাবলীতে বাজি পুড়িয়ে কেবল দূষণফূর্তি করি, এটি আসলে শাস্ত্রোক্ত কর্ম, যার নাম উল্কাদান। সেখানেও প্রথমে ওই অপঘাতে মৃতব্যক্তিদের নাম করে উল্কাদান করে বাকি সকলের জন্য উল্কাদান করা হয়। সারা কার্তিক মাসভর প্রদীপ জ্বেলে রাখতে হয়, পূর্বপুরুষরা উত্তরসূরীদের দেখতে আসবেন বলে।
পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানানোর রীতি রয়েছে তবে তা শোকের সঙ্গে নয়, সংযমের সঙ্গে। অবশ্যই মহালয়ায় পিতৃতর্পণের সঙ্গে ঢাক-ঢোল বাজানোর অনুষঙ্গ নেই, কিন্তু তা বলে শোকের আবহও কিছু নেই।
তাই মহালয়া অতি পুণ্যের দিন, শুভ দিন।