sliderস্থানীয়

অযত্নে অবহেলায় ভাষা শহিদ স্মৃতিচিহ্ন রফিক উদ্দিন আহমেদ গ্রন্থাগার

এম এ কাইয়ুম চৌধুরী: বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গণে এলে পুলিশ গুলি চালায়, এতে রফিক উদ্দিন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।

ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগের জন্য ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন। ২০০৮ সালে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের রফিকনগর গ্রামে তার স্মৃতিতে সরকারিভাবে গড়ে তোলা হয় ভাষাশহিদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। নির্মাণের পরই সেখানে বই ছাড়া ছিল না শহিদ রফিকের কোনো স্মৃতিচিহ্ন। দীর্ঘ ১৫ বছর পর সেখানে যুক্ত হয় ভাষাশহিদ রফিকের ব্যবহার করা কিছু আসবাবপত্র।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সিংগাইর উপজেলার রফিকনগরে অবস্থিত ভাষাশহিদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের একটি কর্নারে শহিদ রফিকের ব্যবহৃত চারটি চেয়ার, একটি টেবিল, ফুলতোলা টেবিল ক্লথ, একটি ফতুয়া ও একটি লুঙ্গি আছে। আর গ্রন্থাগারে সব মিলে বই আছে ১৫ হাজারের মতো। ২০০০ সালে বেসরকারি সংস্থা প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র দুটি আধা-পাকা ঘর তৈরি করে দেয়।

অপরদিকে ২০১৬ সালে শহিদ রফিক উদ্দিন আহমদের বাড়ির সামনে একটি শহিদ মিনার নির্মাণ করে মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদ। তবে, যে ঘরে রফিকের জন্ম সে ঘরটি এখন জরাজীর্ণ। বাড়িটিতে আত্মীয়স্বজন ও দর্শনার্থীদের থাকার উপযোগী নেই কোনো ঘর।

স্থানীয়দের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হলে তারা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ভাষাশহিদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি নামেই করা হয়েছে। অন্য জাদুঘরে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও আমাদের এখানে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা দর্শনার্থীরা বলেন, এখানে তেমন কিছুই নেই। থাকার মধ্যে রফিকের ব্যবহৃত চেয়ার, টেবিল, ফতুয়া ও লুঙ্গি আর বেশ কয়েকটি আলমারিতে কয়েক হাজার বই আছে। দেশের প্রথম ভাষাশহিদ তিনি। তার স্মৃতি রক্ষার্থে তার বাড়ি সংরক্ষণসহ এখানে পর্যটনকেন্দ্র করা হলে আরও ভালো হতো।

ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছরেও রফিকের পরিবারের পাশে না দাঁড়ানোয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে শহিদ পরিবারের।

শহিদ রফিকের ভাতিজা মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশের ভাষাশহিদরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে আজ পর্যন্ত কেউ তেমন কোনো বড় পদক্ষেপ নেয়নি। স্থানীয়দের প্রত্যাশা ছিল গ্রামের নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এলাকায়ও নানা উন্নয়ন হবে। প্রসার ঘটবে শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির। কিন্তু তা হয়নি।’

শহিদ রফিকের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাস এলেই রফিকের পরিবারের গুরুত্ব বাড়ে। এ সময় অনেকে অনেক কিছু করতে চায়। ২১ তারিখ চলে গেলে যে যা প্রতিশ্রুতি দেয় তার সবই ভুলে যায়। তখন আর কেউ খোঁজ রাখেন না। শহিদ রফিক উদ্দিন আহমদকে কবর দেওয়া হয় ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে। এখনো তার কবরটি চিহ্নিত করা হয়নি। জানি না আর কত সময় হলে এটি করা সম্ভব হবে।’

ভাষাশহিদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের লাইব্রেরিয়ান ফরহাদ হোসেন খান বলেন, ‘জাদুঘরে সব মিলে প্রায় ১৫ হাজারের মতো বই আছে। এখানে পড়ার জন্য পর্যাপ্ত চেয়ার ও টেবিলের ব্যবস্থা রয়েছে। তুলনামূলকভাবে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই কম আছে। শুরুর দিকে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই শ দর্শনার্থী এলেও এখন দর্শনার্থীর সংখ্যা খুব কম। গেল বছর জাদুঘরে শহিদ রফিকের ব্যবহার করা চারটি চেয়ার, একটি টেবিল, টেবিল ক্লথ ও গায়ের ফতুয়া ও একটি লুঙ্গি যুক্ত হয়েছে।’

লেখক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মিয়াজান কবির বলেন, ‘রফিক উদ্দিন আহমদ ছিলেন ১৯৫২ সালের প্রথম ভাষাশহিদ। তার স্মৃতিকে জাগ্রত করে রাখার জন্য রফিকের জন্মভিটাকে হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণ করলে এখানে গড়ে উঠতে পারে একটি পর্যটনকেন্দ্র। এ ছাড়া রফিকনগরে নির্মিত জাদুঘরটি আরও সমৃদ্ধ করাসহ এই শহিদের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি।’

বলধারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো.আব্দুল মাজেদ খান বলেন,‘শহিদ রফিক উদ্দিন আহমদ আমাদের অহংকার। ভাষা আন্দোলনে তার আত্মদানে সিংগাইর উপজেলার পারিল গ্রামের মাটি ও মানুষ ধন্য। এই ফেব্রুয়ারি মাসসহ বিভিন্ন সময়ে দেশ ও বিদেশ থেকে দর্শনার্থীরা রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনে আসেন। এখানে থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা না থাকায় হতাশ হয়ে ফিরে যান তারা। তাই দর্শনার্থীদের জন্য একটি বাংলো নির্মাণ করার দাবি জানান তিনি।’

জেলা প্রশাসক ড. মনোয়ার হোসেন বলেন, ভাষাশহিদ রফিকের মায়ের কবর সংরক্ষণ, জাদুঘরে রফিক কর্নার স্থাপনসহ কিছু কাজ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও কাজ করা হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button