তাকে বলা হয় তারকাদের তারকা। খুব বেশিদিনের জীবন নয় তার। অথচ রেখে গিয়েছেন অবিশ্বাস্য সাফল্যের গল্পকথা। যা হার মানায় রূপকথাকেও। তিনি মাইকেল জ্যাকসন।
আজ ২৫ জুন এই তারকার প্রয়াণ দিবস। আজ বিশ্ব সংগীতের শোকমাখা এ দিনে বিশ্বজুড়ে ভক্তরা নানা আয়োজনে স্মরণ করছেন মাইকেল জ্যাকসনকে।
বিশ্ব সংগীতের জনপ্রিয়তার রাজা তিনি। কেউ কেউ ‘দ্যা কিং অব পপ’ বলেও ডাকেন। সংগীত, নৃত্য, অভিনয়, মানবতা ও ভালোবাসার ভুবনে মাইকেল একজন মুগ্ধ জাদুকরের নাম। সংগ্রামী জীবন আর মানুষের ভালোবাসায় তিনি হয়ে ওঠেছিলেন কোটি মানুষের অনুপ্রেরণা।
নানা খেয়ালে ভরপুর ছিল জীবন তার। অনাহারে মানুষ হওয়া লিকলিকে শিশু মাইকেল একদিন ভুবনজয়ী সংগীতপ্রতিভা হবে কে ভাবতে পেরেছিলো! যাদের জীবন ধারণ করতে হয় উদয়াস্ত পরিশ্রমে, গায়ের রঙ কালো বলে যারা প্রতিনিয়ত হয় সামাজিক বৈষম্যের শিকার, জীবনের কোনো সুন্দর কোমল বৃত্তির কথা চিন্তা করাও বিলাসিতা মাত্র- এমন একটি পরিবারেই জন্মেছিলেন মাইকেল জ্যাকসন।
তবে অভাবের হলেও মাইকেলের পরিবার ছিলো সংগীতপ্রিয়। সেই গানপাগল পরিবারের কর্তা ছিলেন জোসেফ জ্যাকসন। নিজে ছিলেন গিটার বাদক। স্ত্রী ক্যাথেরিনও ভালোবাসতেন সংগীতের সুমধুর সুর। তবে নয় সন্তানের বিশাল পরিবার সামলাতে গিয়ে জোসেফের আর গান-বাজনা করার সুযোগ থাকেনি।
বেঁচে থাকার সংগ্রামে নেমে পড়লেও বাবা চাইতেন- তার ছেলে-মেয়েরা গান করুক। তবে তিনি নিশ্চয়ই ভাবেননি- তার সাত নম্বর ছেলেটা এককালে সারা বিশ্বের এক নম্বরের পপ গায়ক হয়ে উঠবেন। কিন্তু তাই হয়েছিলেন মাইকেল জ্যাকসন।
সংগীতে তার অর্জন, সুনামের কাছে পরাজিত হয়েছে এই অঙ্গনে সর্বকালের মানুষদের জনপ্রিয়তা।
মাইকেলের জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের গ্যারি শহরে, ১৯৫৮ সালের ২৯ আগষ্ট। বাবা-মায়ের উৎসাহে ৬০’র দশকে জ্যাকসন পরিবারের অপর তিন সদস্য- জ্যাকি, টিটো এবং জার্মেইনের দলে আরেক ভাই মার্লোনকে সঙ্গে নিয়ে গাইতে শুরু করেন। জ্যাকসন- ৫’র ক্ষুদে সদস্যরা শহরের নানা প্রান্তে গাইতে শুরু করে। তবে বাকিদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি প্রতিভাধর ছিলেন মাইকেল। তার গানের গলাও ছিল বালককন্ঠের হিসেবে অনেক পরিণত। ফলে এই ছোটদের দলটার নেতা হতে খুব বেশি সময় লাগেনি তার।
প্রধান ভোকালিস্ট তিনি ছিলেন- এটা বলাই বাহুল্য! এই দলের মধ্যে প্রতিভার ছোঁয়া খুঁজে পেয়েছিলেন আরেক বিখ্যাতজন ব্যারি গোর্ডি। ফলে তার হাত ধরে জ্যাকসন ৫’র ব্যাক টু ব্যাক অ্যালবাম বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে এক বিষ্ময়কর প্রতিভা মাইকেল জ্যাকসন তার আলাদা জাত চিনিয়ে দিলেন আশেপাশের সবাইকে।
সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আমেরিকার পপ সংগীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে মাইকেল জ্যাকসন যে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তার শুরুটা হয়েছিল ১৯৭১ সালে এককভাবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করে। ১৯৮০ সালে মাত্র ১০ বছরের মধ্যে জ্যাকসন বিশ্বের পপসংগীত শ্রোতাদের কাছে হয়ে ওঠেন নয়নমণি।
১৯৭৯ সালে তার প্রথম সলো অ্যালবাম ‘অফ দ্য ওয়াল’ বের হয় কুইন্সি জোনসের প্রযোজনায়। এই অ্যালবামের চার চারটি গান ইউএস টপচার্টের প্রথম দশটি গানের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল।
শুরু হলো তার একচ্ছত্র আধিপত্য। এলভিস প্রিসলি পপসংগীতের সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও মাইকেল জ্যাকসনকেই শ্রোতারা গুরু ডাকতে শুরু করল। ১৯৮২ সালে তার ‘থ্রিলার’ অ্যালবামটি সারাবিশ্বে বেস্ট সেলিং অ্যালবাম হিসেবেই ইতিহাস গড়ে।
১৯৭৯ সালে ‘অব দ্য ওয়াল’, ১৯৮৭ সালে ‘ব্যাড’, ১৯৯১ সালে ‘ডেঞ্জারাস’ এবং ১৯৯৫ সালে ‘হিস্টরি’ শিরোনামের অ্যালবামগুলোও বেস্ট সেলিং খেতাব গড়তে সক্ষম হয়েছে।
তারকাখ্যাতির সঙ্গে অর্থ-বিত্তের প্রাচুর্যে রূপকথার জীবন কাটাতে লাগলেন মাইকেল জ্যাকসন। গানের তালে তালে মাইকেলের নাচের কৌশলগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মাইকেলের জনপ্রিয় নাচের মধ্যে রবোট, ও মুনওয়াক (চাঁদে হাঁটা) অন্যতম।
এমটিভি কালোদের গান প্রচার করত না। কিন্তু মাইকেলের থ্রিলার ভেঙে ফেলে সেই বাঁধা। সব বাঁধা পেরিয়ে বিশ্বের বুকে মাইকেল জ্যাকসন নিজেকে তুলে ধরেন। ২০০১ সালে থ্রিলারের একটি রিভাইসড এডিশন বের হয়। এরপর ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৮ সালে বের হয় ডিলাক্স এডিশন থ্রিলার ২৫। যাতে নতুন একটি গান, সাক্ষাৎকারসহ যুক্ত হয় নানা ফিচার।
১৯৮৭ সালে থ্রিলার’র রেকর্ড ভাঙা সাফল্যের পর এর কাছাকাছি যাওয়াও ছিল বিশাল কঠিন কাজ। মাত্র পাঁচ বছর পর ‘ব্যাড’ অ্যালবামটি দিয়ে সে কাজটাই করলেন মাইকেল জ্যাকসন। ম্যান ইন দ্য মিরর, দা ওয়ে ইউ মেক মি ফিল এর মতো গান দিয়ে নিজের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিলেন কিং অব পপ।
এর পাশাপাশি মাইকেল জ্যাকসনের সেরা পাঁচটি ভিডিও রয়েছে যেগুলো এই তারকাকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে সর্বকালের সেরা একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবেও। সেগুলোর উল্লেখযোগ্য একটি ১৯৯৫ সালে রিলিজ হওয়া বোন জ্যানেট জ্যাকসনের সাথে অংশ নেওয়া ‘চাইল্ডহোল্ড’ নামের গানের ভিডিও। নিজের ছোটবেলায় সহ্য করা অসঙ্গতিগুলো নিয়েই এই গান।
তারপর আসে ‘বিট ইট’ শিরোনামের গানের ভিডিও। ১৯৮৩ সালে বাজারে আসা এই ভিডিওটি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
গান ছাড়াও ‘এমজে’ ছিলেন চলচ্চিত্রেও একজন সফল তারকা। তার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘দ্য উইজ’। মিউজিক্যাল এই মুভিতে এক কাকতাড়ুয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এর আট বছর পর ১৯৮৬ সালে অভিনয় করলেন ‘ক্যাপ্টেন ইও’র নাম ভূমিকায়। থ্রি-ডি প্রযুক্তিতে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি ছিল স্পেশাল ইফেক্টনির্ভর। ছিল ব্যবসাসফলও। ১৯৮৮ সালে বের হয় ‘মুনওয়াকার’। এটাকে চলচ্চিত্র না বলে মিউজিক ভিডিওর কালেকশনও বলা যেতে পারে।
এর প্রায় নয় বছর পর ১৯৯৭ সালে মাইকেল অভিনয়ে ফেরেন হরর চরিত্রে। ছবির নামও সে রকম ‘ঘোস্ট’। তবে বর্তমান প্রজন্ম মাইকেলকে অভিনেতা হিসেবে বেশি চিনেছে ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সাই-ফাই ছবি ‘মেন ইন ব্ল্যাক টু’ দিয়ে। টমি লি জোনস ও উইল স্মিথের সঙ্গে মাইকেল ছিলেন অতিথি চরিত্রে। মাইকেলের শেষ চলচ্চিত্র ‘মাইকেল জ্যাকসনস দিস ইজ ইট’।
জীবনে অর্জন করার মতো প্রায় সবই তিনি জয় করে নিয়েছিলেন। মাইকেল জ্যাকসন দু’বার ‘রক এন রোল হল অফ ফেম’-এ অন্তভূর্ক্ত হয়েছেন। সারা বিশ্বের সবচেয়ে বিক্রিত অ্যালবামের স্রষ্টাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। পাশাপাশি ১৩ বার গ্রামি অ্যাওয়ার্ড জেতার রেকর্ডও তার দখলে। এসব অর্জন দিয়ে মাইকেলকে মাপা সম্ভব হবে না। মাইকেলের কাছে সব কিছুর উর্দ্ধে ছিলো মানুষের ভালোবাসা। এ বিশ্বে আর কোনো তারকা এতো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করেননি।
দাম্পত্য জীবনে ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলেন বিশ্বের সব রকস্টারের স্বপ্ন নায়ক এলভিস প্রিসলির একমাত্র সন্তান লিসা মেরি প্রিসলিকে বিয়ে করে। কিন্তু অল্প দিনেই ভাঙন আসে এই সুখের সংসারে। ১৯৯৬ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ৯৭’ সালে আবারো বিয়ের পিঁড়িতে বসেন পপ সম্রাট। পেশায় নার্স এই ভদ্রমহিলার নাম ডোবরা জেনি রো। তারা দু’বছর সংসার করার পর ১৯৯৯ সালে আলাদা হয়ে যান এবং তালাকের সময় দুই সন্তানের প্রতিপালনের দায়িত্ব ডোবরা মাইকেলকে প্রদান করেন।
জ্যাকসনের তিন ছেলে-মেয়ে। পুত্র প্রিন্স মাইকেল জন্ম নেয় ১৯৯৭ সালে। মেয়ে ক্যাথরিনা জন্মায় ১৯৯৮ সালে। প্রিন্স মাইকেল টু নামে তার একটি পুত্র আছে যে ২০০২ সালে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু তার মায়ের ব্যাপারে কোনো কিছু জানা যায় না।
জীবনের শেষ দিকে এসে নানা যন্ত্রণায় বিরক্ত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তিনি। জানা যায়, এ ব্যাপারে তার প্রযোজক বন্ধু ও গীতিকার ডেভিড ওয়ার্নসবি ও ফিলিপ বুবাল তাকে সহায়তা করেন। তারা তাকে বুঝাতে সক্ষম হন তারা ইসলাম গ্রহণ করে কিভাবে সুন্দর জীবন যাপন করছেন। মুসলিম হবার পর তিনি মিকাঈল নাম গ্রহণ করেছিলেন।
মাইকেল মানুষের দুঃখ-কষ্ট গভীর আবেগ দিয়ে অনুভব করতেন, তার এ আবেগ তিনি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন গানের মাধ্যমে। পরিতাপের বিষয়, জীবনে কারও ভালোবাসা বা সদয় আচরণ পাননি সংগীতের এই রাজা। না তার বাবা-মা, না মার্কিন মিডিয়া, না মার্কিন বিচারব্যবস্থা; কেউ তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। এমনকি তার মৃত্যুর পরও অনেকে তাকে নিয়ে সমালোচনায় মেতেছেন!
যার হৃদয় মানুষ ও মানবতার প্রার্থনায় নিমগ্ন, ঈশ্বর ভালোবেসে যার হাতে তুলে দিয়েছেন সুরের মোহন বাঁশি তাকে অপদস্ত করে সে সাধ্য মানুষের কই! মাইকেল জ্যাকসন গানের জগতে এক বিস্ময়কর মানব হয়েই রইলেন।
২০০৯ সালের ২৫ জুন শেষরাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লস এঞ্জেলেসের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন মাইকেল জ্যাকসন।
সৌজন্যে : জাগো নিউজ ।